বিরোধীদলীয় নেতার পদ নিয়ে জাতীয় পার্টিতে (জাপা) চলছে দেবর-ভাবির জবর লড়াই। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গড়া দলটি আরও একবার ভাঙনের মুখোমুখি। বিরোধীদলীয় নেতা হতে চেয়ে স্পিকারকে দেওয়া জিএম কাদেরের চিঠিকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে গতকাল বুধবার পাল্টা চিঠি দিয়েছেন এরশাদপত্নী রওশন এরশাদ।
জাপার চেয়ারম্যান পদে জিএম কাদেরের দায়িত্ব পালনকেও অবৈধ আখ্যা দিয়েছেন দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদের অনুসারীরা। আইনি ও রাজনৈতিক লড়াইয়ের কথা বলেছেন তারা। জাপা সূত্র গতকাল বুধবার জানিয়েছে, দুই পক্ষই চেষ্টা করছে, সরকারের আনুকূল্য পেতে। সরকার যার পক্ষে থাকবে তিনিই শেষপর্যন্ত বসবেন এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া বিরোধীদলীয় নেতার আসনে।
সূত্রটি আরও জানিয়েছে, এরশাদের মৃত্যুর পর জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের মধ্যে যে ‘জেন্টলম্যান এগ্রিমেন্ট’ হয়েছিল, তা ভেঙে গেছে পাল্টাপাল্টি চিঠিতে। তাদের বিরোধে রংপুর-৩ আসনে এরশাদপুত্র রাহগীর আল মাহি সাদের দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্তি অনিশ্চিত হয়ে গেছে।
কী সিদ্ধান্ত নেবেন স্পিকার :আইন অনুযায়ী, বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনের একক ক্ষমতা স্পিকারের। কিন্তু তার সামনে সংবিধান ও কার্যপ্রণালি বিধিতে বিশেষ নির্দেশনা নেই। কার্যপ্রণালি বিধিতে বলা আছে- ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ অর্থ স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমতে দল বা অধিসঙ্গের নেতা।
এ বিষয়ে গতকাল স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, জাতীয় পার্টির চিঠি নিয়ে আইন-কানুন খতিয়ে দেখবেন। সংবিধান ও কার্যপ্রণালি বিধির পাশাপাশি সংসদের রেওয়াজও খতিয়ে দেখা হবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। স্পিকার জানান, আগামী ৮ সেপ্টেম্বর সংসদের চতুর্থ অধিবেশন শুরুর আগেই তিনি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে পারেন।
দিনভর কথার লড়াই :১৯৯৬ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতিতে আসা জিএম কাদের ও রওশন এরশাদ, সেই সময় থেকেই পরস্পরের বিরোধী। এরশাদ জীবদ্দশায় দেবর-ভাবির বিরোধ সামাল দিয়ে চললেও, তার মৃত্যুর পর লড়াই প্রকট হয়েছে। গতকাল দিনভর পাল্টাপাল্টি বক্তব্য এসেছে জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের শিবির থেকে। নিজের অবস্থান জানাতে আজ সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন বিরোধীদলীয় উপনেতা রওশন। স্বামীর মৃত্যুর পর আজই তিনি প্রথম গণমাধ্যমের সামনে আসতে যাচ্ছেন।
বিরোধীদলীয় নেতা হতে চেয়ে গত মঙ্গলবার জাতীয় পার্টির প্যাডে স্পিকারকে যে চিঠি দিয়েছেন জিএম কাদের, তাতে দলের ২৫ এমপির ১৫ জনের সই রয়েছে। জাপার প্রেসিডিয়ামের সর্বসম্মত সমর্থন রয়েছে বলেও চিঠিতে দাবি করা হয়েছে।
এ চিঠির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে গতকাল দুপুরে গুলশানের বাসায় দলের কয়েকজন নেতা ও এমপিকে নিয়ে বৈঠক করেন রওশন এরশাদ। আড়াই ঘণ্টার বৈঠক শেষে বিরোধীদলীয় উপনেতার প্যাডে লেখা পাল্টা চিঠিতে তিনি স্পিকারকে বলেছেন, দলীয় ফোরামের সিদ্ধান্ত ছাড়াই জিএম কাদের চিঠি দিয়েছেন। তার চিঠি আমলে না নিতে অনুরোধ করেছেন রওশন এরশাদ। স্পিকারের ব্যক্তিগত সচিব কামাল বিল্লাহ রওশন এরশাদের চিঠির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
রওশন এরশাদের বাসায় বৈঠকে অংশ নেওয়া জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছেন, জিএম কাদেরের চিঠির মূল্য নেই। চিঠি দিয়ে নেতা হওয়া যায় না। বিরোধীদলীয় নেতা কে হবেন, তা নির্ধারিত হবে সংসদীয় দলের সভায়। রওশন এরশাদই এখন জাপার সংসদীয় দলের নেতা। সংসদীয় দলের সভা ডাকার এখতিয়ার একমাত্র তার।
তবে জিএম কাদের গতকাল বিকেলে জাপার বনানী কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর চিঠির মাধ্যমেই বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছিলেন এরশাদ। তাকে বিরোধীদলীয় উপনেতা করেছিলেন। আড়াই মাস পর তাকে সরিয়ে রওশন এরশাদকে উপনেতা করা হয় চিঠির মাধ্যমেই। তার প্রশ্ন, তখন যদি সংসদীয় দলের সভা ছাড়াই চিঠির মাধ্যমে বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতা নির্বাচন করা যায়, উপনেতা পরিবর্তন করা যায়, তাহলে এখন কেন সভা করতে হবে?
এর জবাবে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছেন, এরশাদ ছিলেন জাপার নির্বাচিত চেয়ারম্যান। গঠনতন্ত্রে তাকে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জিএম কাদের চেয়ারম্যান নন। তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন আগামী কাউন্সিলে। তার আগ পর্যন্ত জিএম কাদের শুধুই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তার দায়িত্ব দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা এবং প্রেসিডিয়ামের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামত নিয়ে চলা। গত ২২ জুলাই বিবৃতিতে একই কথা বলেছিলেন রওশন।
জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেছেন, অতীতের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানরা ছিলেন এরশাদের জীবদ্দশায়। জিএম কাদের ভারপ্রাপ্ত থেকে পূর্ণাঙ্গ চেয়ারম্যান হয়েছেন এরশাদের মৃত্যুর পর। এরশাদ তাকে জাপার গঠনতন্ত্র অনুযায়ী লিখিতভাবে এ দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।
এরশাদের মৃত্যুর পর জাপার প্রেসিডিয়ামে আটজনকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন জিএম কাদের। তার এ সিদ্ধান্তকেও অবৈধ আখ্যা দিয়ে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছেন, স্পিকারকে দেওয়া চিঠিতে প্রেসিডিয়ামের যে সর্বসম্মতির কথা বলা হচ্ছে তা মিথ্যা। প্রেসিডিয়ামে অবৈধভাবে সদস্য নিয়োগ দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন জিএম কাদের।
রওশন এরশাদের চিঠি স্পিকারের কার্যালয়ে পৌঁছে দেন জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেছেন, রওশন এরশাদসহ অনেক এমপিকে না জানিয়ে স্পিকারকে চিঠি দিয়েছেন জিএম কাদের। তার মতামতও নেওয়া হয়নি। জিএম কাদের বলেছেন, তিনি ২৫ এমপির ১৫ জনের সমর্থন পেয়েছেন। তাই বাকিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। আরও অনেকেই তাকে সমর্থন দিতে ইচ্ছুক।
গোড়া থেকেই বিরোধে দেবর-ভাবি :জাপায় দীর্ঘ সময় রওশন এবং তার অনুসারীরা পরিচিত ছিলেন বিএনপিপন্থি হিসেবে। জিএম কাদের ছিলেন আওয়ামী লীগপন্থি। ২০০৯ সাল থেকে পাঁচ বছর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন প্রথম মহাজোট সরকারে মন্ত্রী ছিলেন তিনি। ২০১৩ সালের শেষ দিকে অবস্থান বদলান দু’জনই। রওশনের নেতৃত্বে জাপার একাংশ বিএনপিবিহীন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেন। এরশাদের নির্দেশে নির্বাচন বর্জন করে জিএম কাদের আওয়ামী লীগের সমালোচকে পরিণত হন।
একাদশ নির্বাচনের আগে থেকে রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের দু’জনেই সরকার সমর্থকের ভূমিকায় রয়েছেন। জাপার একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেছেন, রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের দু’জনেই সরকারের পক্ষে। যিনি সরকারের সমর্থন পাবেন তিনিই বিরোধীদলীয় নেতা হবেন।
জিএম কাদেরের পক্ষে যারা :ফিরোজ রশীদ, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, নাজমা আকতার, শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ, মেজর (অব.) রানা মোহাম্মদ সোহেল, আহসান আদেলুর রহমান, মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, মাসুদা রশিদ চৌধুরী, লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দীন চৌধুরী, গোলাম কিবরিয়া টিপু, নুরুল ইসলাম তালুকদার, সালমা ইসলাম, পনির উদ্দিন আহমেদ।
রওশনের পক্ষে যারা :আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু, ফখরুল ইমাম, লিয়াকত হোসেন খোকা, রওশন আরা মান্নান। দেবর-ভাবির বিরোধ থেকে দূরে রয়েছেন, ডা. রুস্তম আলী ফরাজী, পীর ফজলুর রহমান মেসবাহ, নাসরিন জাহান রত্না ও সেলিম ওসমান।
সাদের মনোনয়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা :জাপার প্রেসিডিয়ামের একজন সদস্য জানিয়েছেন, এরশাদের মৃত্যুর পর দেবর-ভাবির মধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছিল। রওশন এরশাদের ইচ্ছা অনুসারে সাদকে রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে মনোনয়ন দিতে রাজি হয়েছিলেন জিএম কাদের। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতা হতে কাদেরের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন রওশন। তাই সাদের মনোনয়নও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আইনানুযায়ী জিএম কাদেরের সই ছাড়া দলের প্রার্থী হতে পারবেন না সাদ। এরশাদের ভাতিজা, ভাগ্নিও সাদের বিরোধী। রংপুরের নেতারাও তার বিরোধী। তবে সাদ বলেছেন, এসব নিয়ে তিনি ভাবছেন না। তিনি মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।