“আমাদের দেশকে পুনরুদ্ধারের জন্য আমাদেরই লড়াই করতে হবে।”
জুলাই মাসের কোনো একদিন কক্সবাজারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির থেকে পালিয়ে ছোট্ট একটি নৌকায় করে নাফ নদী পেরিয়ে রফিক প্রবেশ করেন মিয়ানমারে, যে দেশ থেকে তিনি জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এসেছিলেন ২০১৭ সালে। তার উদ্দেশ্যে ছিল, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে যোগ দেওয়া।
বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের জেলা কক্সবাজারের ওই আশ্রয় শিবিরে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। গত এক বছরে সেখানে সশস্ত্র দলগুলোর সদস্য সংগ্রহ এবং সহিংসতা- দুটোই বেড়েছে। ৩২ বছর বয়সী রফিকের মত হাজারো রোহিঙ্গা সেখান থেকে মিয়ানমারে ফিরে গেছেন যুদ্ধে যোগ দিতে। ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবগত অন্তত চারজনের বক্তব্য এবং দুটি ত্রাণ সংস্থার অভ্যান্তরীণ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জেনেছে রয়টার্স।
রফিক রয়টার্সকে বলেন, “আমাদের দেশকে পুনরুদ্ধারের জন্য আমাদেরই লড়াই করতে হবে।”
একহারা গড়নের শ্মশ্রুমণ্ডিত এই যুবক সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ফিরে এসেছেন, কারণ সেখানে যুদ্ধ করার সময় তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন।
আশ্রয় শিবিরেই রফিকের সঙ্গে রয়টার্সের কথা হয়। তিনি বলেন, “লড়াই করা ছাড়া আমাদের আর পথ নেই।”
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন থেকে বাঁচতে ২০১৬ সালে দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে রোহিঙ্গা মুসলমানরা।
মিয়ানমারে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিদ্রোহ ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর আরও জোরালো হয়েছে। বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে চলমান এই জটিল সংঘাতে এখন রোহিঙ্গা যোদ্ধারাও যুক্ত হচ্ছেন।
রোহিঙ্গাদের অনেকে আবার সেই সব গোষ্ঠীর হয়ে লড়াইয়ে যোগ দিচ্ছেন, তাদের নির্যাতনকারী জান্তাবাহিনীর সঙ্গে যাদের যোগাযোগ আছে। তারা লড়াই করছেন রাখাইন রাজ্যের বিদ্রোহী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে।
রয়টার্স ১৮ জন রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নিয়েছে। বাংলাদেশী শরণার্থী শিবিরের ভেতরে কীভাবে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো সংগঠিত হচ্ছে, সে বিষয়ে তারা কথা বলেছেন। পাশাপাশি সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে দাতা সংস্থাগুলোর লেখা দুটো অভ্যন্তরীণ ব্রিফিং দেখেছে রয়টার্স।
বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরগুলো থেকে ৩ থেকে ৫ হাজার যোদ্ধা সংগ্রহ করেছে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়া, রোহিঙ্গাদের যুদ্ধে নামাতে জান্তা বাহিনীর অর্থ এবং নাগরিকত্বের প্রলোভন এবং এসব বিষয়ে বাংলাদেশি কিছু কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার তথ্যও রয়টার্স পেয়েছে।
সেখানকার রোহিঙ্গা যোদ্ধা, ত্রাণকর্মী এবং বাংলাদেশের কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে রয়টার্স কথা বলেছে যারা নিজেদের নাম প্রকাশ করতে চাননি।
এ বিষয়ে রয়টার্সের প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়নি বাংলাদেশ সরকার। আর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের প্রলোভন দেখানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
সেই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “মুসলমান রোহিঙ্গারা সুরক্ষা চেয়েছিল। তাই তাদের নিজ নিজ গ্রাম ও অঞ্চল রক্ষার জন্য প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।”
বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান রয়টার্সকে বলেন, কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) খুব বেশি কর্মী আছে বলে তিনি মনে করেন না।
কিন্তু নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, আশ্রয় শিবিরে সশস্ত্র রোহিঙ্গা যোদ্ধাদের উপস্থিতি এবং অস্ত্রের সরবরাহ বাংলাদেশের জন্য বিপদ হয়ে দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরগুলোতে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে প্রতি বছর জন্ম নিচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু।
অধ্যাপক খান বলেন, “দারিদ্র্য ও সহিংসতার কারণে হতাশায় ভোগা শরণার্থীরা সহজেই জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়ে পড়তে পারে, এমনকি অপরাধী চক্রের সঙ্গেও যুক্ত হতে পারে। এর প্রভাব এ আঞ্চলের অন্য দেশের ওপরও পড়বে।”
গত বর্ষার মাঝামাঝি সময়ে নৌকায় করে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের শহর মংডুতে যান রোহিঙ্গা বিদ্রোহী আবু আফনা।
তিনি রয়টার্সকে বলেছেন, সেখানে পৌঁছানোর পর জান্তার সেনারা তাকে আশ্রয় দেয় ও অস্ত্র সরবরাহ করে।
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আফনা বলেন, “আমি যখন জান্তা সেনাদের সঙ্গে থাকতাম, তখন আমার মনে হত, আমি সেই লোকদের পাশে দাঁড়িয়ে আছি, যারা আমাদের মা-বোনদের ধর্ষণ করেছে, হত্যা করেছে।”
ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়ছে জান্তা বাহিনী। মূলত বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইন সম্প্রদায় আরাকান আর্মিকে সমর্থন দিচ্ছে। তাদের কেউ কেউ আবার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের সময় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল।
মিয়ানমারে টিকে থাকা রোহিঙ্গাদের অন্যতম বড় বসতি পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য যে আরাকান আর্মি দায়ী, আর তাদের সঙ্গে লড়ার বিষয়ে আরএসও যে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছেছে, চলতি বছর রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে সেই বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছিল।
আবু আফনা বলেন, “আমাদের প্রধান শত্রু মিয়ানমার সরকার নয়, রাখাইন সম্প্রদায়।”
আবু আফনার ভাষ্য, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের অস্ত্র, প্রশিক্ষণ এবং অর্থ যুগিয়েছে।
একটি বাংলাদেশি সূত্র এবং আরেক রোহিঙ্গা যুবকও রয়টার্সকে একই কথা বলেছে। ওই দ্বিতীয় রোহিঙ্গা যুবকের ভাষ্য, তাকে জান্তার পক্ষে লড়তে বাধ্য করা হয়েছে।
তারা এটাও বলেছেন, জান্তা বাহিনী এর বিনিময়ে মিয়ানমারের নাগরিকত্বের নথিপত্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাদের।
কারও কারও জন্য নাগরিকত্বের নথিপত্র দেওয়ার বিষয়টি খুবই খুবই লোভনীয় একটি প্রস্তাব, কারণ মিয়ানমারে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। এখন তাদের জীবন আবদ্ধ বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে।
আবু আফনা বলেন, “আমরা টাকার জন্য যুদ্ধে যাইনি। গিয়েছিলাম নাগরিকত্বের জন্য, ফিরে পেতে চেয়েছিলাম জন্মভূমি।
মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গাকে ‘নাগরিকত্ব ও আর্থিক প্রলোভন, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, হুমকি ও জবরদস্তি’ করে জান্তার হয়ে যুদ্ধ করার জন্য দলে টানার তথ্য একটি ত্রাণ সংস্থার জুন মাসের ব্রিফিংয়ে রয়টার্স দেখেছে।
জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা এবং দুই রোহিঙ্গা যোদ্ধার তথ্য অনুযায়ী, প্রলোভন দেখিয়ে ১৩ বছরের এক শিশুকে পর্যন্ত জোর করে যুদ্ধে নিয়ে গেছে জান্তা বাহিনী।
অর্থসংকটে থাকা বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে ক্রমেই অনাগ্রহী হয়ে উঠছে। একটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, সশস্ত্র সংগ্রামই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরার একমাত্র উপায় বলে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের কেউ কেউ মনে করেন । তারা এও মনে করেন, বাংলাদেশ কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন দিলে তাতে মিয়ানমারের সঙ্গে দর কষাকষির জায়গা আরো বাড়বে।
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মঞ্জুর কাদের রয়টার্সকে বলেছেন, তিনিও মনে করেন, সরকারের এখন রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগ্রামে সমর্থন দেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
কাদের বলেন, বিগত বাংলাদেশ সরকারের আমলে কিছু গোয়েন্দা কর্মকর্তা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিলেও সার্বিক দিক নির্দেশনা না থাকায় সেভাবে সমন্বয় ছিল না।
রোহিঙ্গা যোদ্ধা আবু আফনা রয়টার্সকে বলেছেন, এ বছরের শুরুর দিকে কয়েক ডজন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা মংডুতে নিয়ে যান।
সেদিনের এক কর্মকর্তার কথা থেকে উদ্ধৃত করে আফনা বলেন, “এটা তোমাদের দেশ, তোমরা লড়াই করে তোমাদের অধিকার ফিরিয়ে নাও।”
তবে রয়টার্স স্বাধীনভাবে তার এ কথার সত্যতা যাচাই করতে পারেনি।
‘আতঙ্কের মধ্যে বসবাস’
রাখাইন রাজ্যে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ও উন্নত মহড়া চালানো আরাকান আর্মিকে হটিয়ে দিতে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্রোহীরা।
তবে মংডুর লড়াই ছয় মাস ধরে চলছে এবং রোহিঙ্গা যোদ্ধারা বলছে, অতর্কিত হামলাসহ কৌশল বিদ্রোহীদের অভিযানের গতি কমিয়ে রেখেছে।
পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত এক বাংলাদেশি কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, “আরাকান আর্মি ভেবেছিল তারা খুব শিগগিরই বিজয় অর্জন করবে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণের কারণে মংডু তাদের ভুল প্রমাণ করেছে।”
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মঞ্জুর কাদের এবং বিষয়টির সাথে পরিচিত অন্য এক ব্যক্তির ভাষ্য, এ বছরের শুরুর দিকে রোহিঙ্গা ও আরাকান আর্মির মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছিল বাংলাদেশ। তবে সেই আলোচনায় কোনো সমঝোতা হয়নি।
তারা রয়টার্সকে বলেছেন, রোহিঙ্গা বসতিতে আরাকান আর্মির আক্রমণের কৌশলে বাংলাদেশ ক্রমেই ক্ষুব্ধ হচ্ছে, কারণ সহিংসতার কারণে শরণার্থীদের রাখাইনে ফেরানোর চেষ্টায় জটিলতা তৈরি হচ্ছে।
যদিও আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের অবস্থানে হামলার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে।
বর্তমানে কক্সবাজারে ক্যাম্পগুলোতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আরএসও ও আরসা সেখানে প্রভাব বিস্তারের জন্য লড়ছে।
মারামারি এবং গোলাগুলি এখন রোহিঙ্গা শিবিরের সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাতে মানবিক সহায়তাকর্মীরা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন।
মানবাধিকার সংস্থা ফর্টিফাই রাইটসের পরিচালক জন কুইনলি রয়টার্সকে বলেন, ২০১৭ সালে শিবিরগুলো প্রতিষ্ঠার পর এখনই সহিংসতার ঘটনা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
“চলতি বছর সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো অন্তত ৬০ জনকে হত্যা করেছে। বিরোধীদের অপহরণ ও নির্যাতন করছে। এমনকি সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার জন্য হুমকি দিচ্ছে।”
বাংলাদেশে নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের পরিচালক ওয়েন্ডি ম্যাককেনস সতর্ক করে বলেছেন, শরণার্থী শিবিরের জন্য বরাদ্দ আন্তর্জাতিক তহবিল আগামী ১০ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
শরণার্থীদের জীবিকা নির্বাহের সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “উপার্জনের পথ না পেলে মানুষ, বিশেষত তরুণেরা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোতে সম্পৃক্ত হয়ে আয়ের পথ খুঁজবে।”
গত মে মাসে স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে মংডু থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরিৎ উল্লাহ নিয়মিত রেশন জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন।
এক সময় ধান ও চিংড়ি চাষ করতেন শরিৎ। তিনি বলেন, ক্রমবর্ধমান সহিংসতার মধ্যে তার সবচেয়ে বড় উদ্বেগ এখন পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে।
তিনি বলেন, “আমাদের এখানে কিছুই নেই। আমরা আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছি।”