২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৬ জুন) বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে এ বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’- প্রতিপাদ্য নিয়ে উত্থাপন করা প্রস্তাবিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এছাড়া জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখার লক্ষ্যও নেওয়া হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে।
কঠিন সময়ে চ্যালেঞ্জের বাজেটের লক্ষ্য বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ উত্তাল বৈতরণী সামাল দেওয়া। এর অংশ হিসেবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে আনা ও ব্যাংকিংখাতের অস্থিরতা সামাল দেওয়ার মতো কঠোর পরিস্থিতি মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় উঠে এসেছে মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কথাও।
প্রস্তাবিত এই বাজেটে দ্রব্যমূল্যসহ ১১টি বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া; কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা; আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা; লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি; দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বাড়িয়ে শিল্পের প্রসার ঘটানো; ব্যাংকসহ আর্থিকখাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানো; নিম্নআয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা; সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সবাইকে যুক্ত করা ইত্যাদি।
এছাড়া প্রতিবছরের মতো এবারও কয়েকটি খাত ও পণ্যে শুল্ক বাড়ানো ও কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে সিগারেট, পানির ফিল্টার, কাজুবাদাম, ফ্রিজ. এসি, আইসক্রিম, বেভারেজ, ইট, এলইডি বাল্ব, তামাকজাতীয় দ্রব্য, অপরিশোধিত ভোজ্যতেল, টিউব লিসেনিং জেল, কৃত্রিম কোরান্ডাম, অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড, ফ্লোরোসেন্ট বাতির যন্ত্রাংশ, কাচ, প্লাস্টিক, মেডিকেল যন্ত্র, সরঞ্জাম, মূলধনী যন্ত্রাংশ, নির্মাণসামগ্রী, সিম কার্ড, নিলামকারী সংস্থা, সিকিউরিটি সার্ভিস ও লটারির টিকিট ইত্যাদি পণ্যের দাম বাড়তে পারে। কমতে পরে প্যাকেটজাত গুঁড়া দুধ, দেশে তৈরি মোটরসাইকেল, ল্যাপটপ, পলিপ্রোপাইলিন ইয়ার্ন, লোহাজাতীয় পণ্য, ইলেক্ট্রিক মোটর, সুইচ-সকেট, ডায়ালাইসিস ফিল্টার, স্পাইনাল সিরিঞ্জ ও ডেঙ্গু কিটসহ অনেক পণ্যের দাম।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এই বাজেটকে ‘স্মার্ট ইকোনমির’ বাজেট বললেও এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সাধারণ মানুষের মাঝে।
বাজেট উপস্থাপনের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলানিউজের কাছে নিজেদের মতামত জানান বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
প্রস্তাবিত বাজেটকে সরকারের ভালো উদ্যোগ বলেও এটি বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির প্রভাষক সাজেদা আক্তার।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিবছরের ধারাবাহিকতায় এ বছরও বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রায় ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার একটি বিশাল বাজেট উত্থাপন করে। নতুন সরকারের এই বাজেটটি অধিক গুরুত্ব বহন করে। কারণ এটি আমাদের অষ্টম-পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষ বাজেট। তাছাড়া বর্তমান চলমান অর্থনৈতিক সংকট, যেমন- মুদ্রাস্ফীতি, সামগ্রিক অর্থনৈতিক চাহিদা নিয়ন্ত্রণ এবং সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের জীবন-মান নিয়ন্ত্রণের বা ভারসাম্য বজায় রাখার দিকটি উঠে আসছে কি না এই বাজেটে, সেদিক বিবেচনা করলেও এই বাজেটটি গুরুত্ব বহন করছে। প্রস্তাবিত বাজেটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এর মধ্যে কিছু কর কাঠামোর পরিবর্তন এসেছে। যেমন- চাল, চিনি, তেল, দুধসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ওপর করের হার কমানো হয়েছে। যা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে মনে করি।
তিনি আরও বলেন, এই বাজেট নিম্নআয়ের মানুষদের স্বস্তি দিলেও এটি ততক্ষণ পর্যন্ত সুফল বয়ে আনবে না যতক্ষণ পর্যন্ত যথাযথ বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে তা কার্যকর করা না হয়। এছাড়া বার্ষিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মুদ্রানীতি নেওয়া না হলেও তা কতটা নিম্নআয়ের জনগণকে স্বস্তি দিতে সক্ষম হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে নিম্নআয়ের মানুষের অধিকারের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে এর আওতা আরও বাড়ানো উচিত বলে আমি মনে করি। একইসঙ্গে আইএমএফের নীতি অনুযায়ী প্রতিবছর রাজস্ব আয়ের শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ বাড়ানোর দিকে সরকার যে জোর দিচ্ছে, সেটি পূরণ করতে গিয়ে যেন পরোক্ষ কর বাড়ানো না হয়। কারণ এটি নিম্নআয়ের মানুষেরই বহন করতে হবে। এতে তাদের জীবনমান উন্নয়নের পরিবর্তে অবনয়ন ঘটতে পারে।
সংস্কৃতিকর্মী এবং নাটক ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা বান্টি আফজাল বলেন, ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’। ভারি ভারি শব্দে ভরপুর বাজেট ঘোষণায় আমি অন্তত নতুন কিছুই দেখছি না। সাধারণ জনগণের সম্ভবত এখন ভাতের দাবি! দেশে বিলুপ্তপ্রায় মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর নাভিশ্বাস বাড়বে বৈ কমবে বলে আমার মনে হয় না। দেশের মুষ্টিমেয় কিছু অসাধু ব্যবসায়ীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য ঘোষিত বাজেট পরিকল্পনা এদেশে নতুন কিছু নয়। প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার সময় এলেই আমার শিয়ালের কুমিরের বাচ্চা দেখানোর সেই গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। বিমানের ইঞ্জিন বা প্রপেলারের দাম কমাতে আমার ব্যক্তিগতভাবে কিছুই যায় আসে না। একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম খাতে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ এবং শিক্ষাখাতে ১২ শতাংশ বরাদ্দের এই প্রহসন দিয়ে আর যাই হোক টেকসই উন্নয়ন বা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব বলে আমি ভাবি না। শিক্ষা এবং সংস্কৃতির উন্নয়নেই যদি আপনার গুরুত্বের মাত্রা হয়, তাহলে আপনার উন্নয়ন চিন্তার টেকসই হওয়াটাই কি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায় না? কালোবাজারিদের সাহায্য করতে গিয়ে আমরা নিজেদের অন্তঃসারশূন্য করে ফেলছি কি না এটা এখনো ভেবে দেখার সময় আছে, না হলে সামান্য বাতাসে তাসের ঘর ভেঙে পড়লে তখন বিলাপের প্রতিধ্বনি ছাড়া আর কিছুই আমরা ফিরে পাবো না।
জাতীয় দৈনিকে শিক্ষা বিষয়ে কাজ করা সাংবাদিক পিয়াস সরকার বলেন, এই বাজেট অনেকটাই অনুমেয় এবং কাট-পেস্ট বাজেট। গরিব মানুষের জন্য এই বাজেটে কিছুই নেই। বিশেষ করে শিক্ষাখাতে বাজেটের অংকটা বাড়লেও সার্বিক হিসেবে তা বাড়েনি। এবার বাজেটে জিডিপির ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যা গত বছর ছিল ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। যেখানে ইউনেস্কো বলছে শিক্ষাখাতে জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ রাখার। এছাড়া শিক্ষাখাতের উন্নয়নে প্রশিক্ষণ বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ দরকার ছিল। কিন্তু শিক্ষার মান উন্নয়নে বরাদ্দ কম দিয়ে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে অবকাঠামো নির্মাণে।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়ুয়া কেয়া চক্রবর্তী বলেন, এ বছরের অর্থবছরে যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে, তা মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত বা খেটে খাওয়া মানুষের জন্য খুব বেশি আশানুরূপ হবে বলে মনে হয় না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে, তার ওপর করের পরিমাণ আরও বাড়ালে অভুক্ত মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে। তাছাড়া শিক্ষা ক্ষেত্রেও আমার মনে হয় শুধু বাজেট বাড়ানোই যথেষ্ট নয়, তাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত করাও জরুরি।
প্রস্তাবিত বাজেটকে উচ্চাভিলাসী ও হাস্যকর বলে অবহিত করেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী মঈন হোসেন।
তিনি বলেন, এই বাজেটে কালো টাকা সাদা করার জন্য ১৫ শতাংশ করের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যেখানে বৈধদের জন্য ৩০ শতাংশ করের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এটা যেন চোরকে চুরি করার সুযোগ দিয়ে পাহারার ব্যবস্থা করার মতো। মোবাইলে কথা বলার ক্ষেত্রে ফের শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এর অর্থ আমি ১শ টাকা রিচার্জ করলে ৬৯ টাকার কথা বলতে পারবো এবং প্রায় ৩০ টাকা সরকার নিয়ে যাবে। বাজেটে সব দায়ভার আমাদের ওপরই চাপানো হয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম কি পরিমাণ বাড়বে সেটা সরকার চিন্তা করে না। এটি সরকার চিন্তা করলে আমাদের দেশটি আরও সুন্দর হত। এই বাজেট কার্যকরী ও আমাদের সাধারণ মানুষের জন্য উপযোগী হয়নি বলে আমার মনে হয়। সবচেয়ে বড় কথা সরকার এই বাজেটের মাধ্যমে চোরকে আরও চুরি করার সুযোগ দিয়েছে।
তবে বাজেট নিয়ে সমাজের নিম্নআয়ের মানুষের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তাদের শুধু নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি ও কমানো নিয়ে কথা বলতে দেখা গেছে।
রাজধানীর রাজাবাজার এলাকার মুদি দোকানি মো. রুবেল বলেন, বাজেটে কিছু কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানোর নাকি প্রস্তাব করা হয়েছে। যেগুলোর দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো বড়লোকেরা ব্যবহার করে। গরিবের ব্যবহারের জিনিসের দাম কমানো হলে মানুষ কিছুটা শান্তি পাবে। যদি সত্যিই নিত্যপণ্যের দাম কমে তাহলে এই বাজেট ভালোই হয়েছে বলে আমার মনে হয়।
রিকশাচালক বুলবুল বলেন, বাজেটে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও কি, কমলেও কি? কয়দিন পর পরই তো জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। আর কমে না। তাইলে বাজেটে কী হয়?