বিএনপির বেশির ভাগ নেতা ও জোটের শরিকের অনেকেই খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে গণ-অনশন কর্মসূচির বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, এমন গণ-অনশন করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা যাবে না। এসব কর্মসূচিতে যদি বিএনপির নেতা-কর্মীরা মরেও যান, তবু তাঁর মুক্তি মিলবে না। তাঁকে মুক্ত করতে হলে রাজপথে আন্দোলন ছাড়া বিকল্প নেই। স্বেচ্ছায় কারাবরণ করার চেয়ে রাজপথে আন্দোলনই খালেদা জিয়ার মুক্তি এনে দিতে পারে।
বিএনপির কারাবন্দী চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা ও মুক্তির দাবিতে আজ রোববার ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সকাল ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত গণ-অনশন কর্মসূচি পালন করে দলটি। আজকের কর্মসূচিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলের নেতারাও অংশ নেন। গণ-অনশন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বিএনপির নেতাদের পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙান।
গণ-অনশন কর্মসূচি শুরুর পর থেকে বিএনপির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারা বক্তব্য দেন। দলটির অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীরা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় ও জোট শরিক দলের নেতারা দলের নীতিনির্ধারকদের কাছে কর্মসূচি চান। তাঁরা বলেন, খালেদা জিয়ার কারাবাসের প্রায় ১৪ মাস চলছে। এর মধ্যে তাঁকে মুক্ত করার জন্য বিএনপি, ঐক্যফ্রন্ট ও ২০–দলীয় জোট বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিয়ে এসেছে, কিন্তু কোনো কার্যকর কর্মসূচি হাতে নেয়নি। এতে করে দলের নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়েছেন। এ ছাড়া যে পরিস্থিতি, তাতে আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তির কোনো সুযোগ নেই। সে জন্য রাজপথে আন্দোলন ছাড়া খালেদা জিয়া ও ‘গণতন্ত্রকে’ মুক্ত করা সম্ভব না।
খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে এর আগেও বেশ কয়েকবার অনশন, প্রতীকী গণ-অনশনের মতো কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। আজকের কর্মসূচিটি নির্ধারিত সময়ের চেয়েও আধা ঘণ্টা বেশি সময় পালন করেছে দলটি। যদিও নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির বেশ কয়েকজন নেতা। অনেকে অভিযোগ করেছেন, অনেক নেতা-কর্মী চেহারা দেখিয়ে দু-একবার স্লোগান দিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। এমন ধরনের নেতা-কর্মী থাকলে কোনো কর্মসূচি দিয়ে কাজ হবে না।
এ ছাড়া বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা সকাল থেকে অনুষ্ঠিত গণ-অনশন কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকলেও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ কর্মসূচিতে উপস্থিত হন বেলা ৩টা ৫ মিনিটে। দলটির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আবদুল মঈন খান কর্মসূচিতে এসে পৌঁছান দুপুর আড়াইটার পর। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মির্জা আব্বাসও দুইটার পর গণ-অনশনে যোগ দেন।
খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, এই ‘অবৈধ’, ‘গণবিচ্ছিন্ন’ সরকারের কাছে খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করে লাভ নেই। তাঁকে জেলে নেওয়া হয়েছে যে উদ্দেশ্যে, সেটি পূরণ হয়েছে। বর্তমানে গায়ের জোরে সরকার ক্ষমতায় টিকে আছে। সরকার খালেদা জিয়াকে কারাগারে রাখতে পারবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা যাবে না। তাঁকে মুক্ত করতে হলে রাজপথের আন্দোলনের বিকল্প নেই। স্লোগান দিয়ে তাঁর মুক্তি হবে না। তিনি বলেন, এই সরকার গত ১০ বছরে মানুষের অনেক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার ঘটনা। সরকার যে শূন্যতা তৈরি করেছে, তা বেশি দিন থাকবে না। এই শূন্যতা পূরণ হবে।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হলে সম্মিলিতভাবে আন্দোলন করতে হবে। আন্দোলন না করলে খালেদা জিয়া ও ‘গণতন্ত্রকে’ মুক্ত করা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, অনেকে বলেন বিএনপি আন্দোলন করতে জানে না। কার বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে? প্রতিপক্ষ দল তো নেই। যেটি আছে, সেটি পত্রিকায় দেখা যায়, বাস্তবে নেই। এই সরকারের একধরনের ভীতি কাজ করে। যে কারণে সরকারের সম্পূর্ণ আস্থা পুলিশ, র্যাব বাহিনী ও অন্য বাহিনীর ওপর। নিজ দলের ওপর আস্থা নেই।
খালেদা জিয়ার প্যারোল মুক্তির বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, প্যারোল মুক্তি নিয়ে ছাড়া পেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। খালেদা জিয়া কখনো প্যারোল নেননি। তিনি প্যারোল নেবেন না। তিনি বলেন, সরকার যদি প্যারোল দিতে পারে, তাহলে আদালতে খালেদা জিয়ার জামিনের বিরোধিতা করা হয় কেন? তিনি খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন এবং দলের নেতা-কর্মীদের আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন।
দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের কাছে কর্মসূচি চেয়ে বিএনপি যুগ্ম মহাসচিব মুজিবুর রহমান সারোয়ার বলেন, ‘২০–দলীয় জোটের কাছে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আহ্বান জানাই। মাহমুদুর রহমান মান্না নন, আমরা ঐক্যফ্রন্টের কাছে খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন আশা করছি। না হলে ঐক্যফ্রন্টকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।’
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘হলের ভেতরে গণ-অনশন করে ১০০ বছরেও শেখ হাসিনাকে নড়াতে পারবেন না। এই “অবৈধ” সরকারের কাছে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি আপনারা করতে পারেন না। করলে আপনাদের পতন হবে।’ বিএনপির নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যদি রাস্তায় নামতে পারেন, নামেন। আরও ১০টা মামলা হবে। দেশটা তো কারাগার হয়ে গেছে। রাস্তায় নামলে একসময় শেখ হাসিনা বলবেন, “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি”।’
জেএসডির সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আরেক নেতা আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘ঘরের মধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তি চাইতে রাজি নই। এখানে ১ হাজার ১০০ জন লোক মারা গেলেও কিছু হবে না। বাংলাদেশে অনেক ধরনের ডিক্টেটর (স্বৈরাচার) এসেছে, কিন্তু এমন সিভিল ডিক্টেটর কখনো আসেনি।’ তিনি বলেন, ‘যদি খালেদা জিয়াকে মুক্তি করতে চান, তাহলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়তে হবে। আমি এখনই রাস্তায় নামতে রাজি আছি। আপনাদের নেতারা রাজি আছে কি না বলুন?’
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও নেতাদের আন্দোলনের দাবি মেনে নেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো প্যারোলে মুক্তির কথা বলিনি। জামিন পাওয়া খালেদা জিয়ার অধিকার। যেসব মামলায় অনেকে জামিন পেয়েছেন, সেখানে তাঁকে জামিন দেওয়া হচ্ছে না। খালেদা জিয়াকে বাইরে আনতে সরকার ভয় পায়।’ তিনি বলেন, সরকার দেশের সব অর্জন, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশ বাঁচাতে এবং খালেদা জিয়াকে যেকোনো মূল্যে মুক্ত করতে হবে। এ জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান, আবদুল মঈন খান, শামসুজ্জামান দুদু, আহমেদ আযম খান, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, আবদুস সালাম, হাবিবুর রহমান হাবিব, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল শহীদউদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। এ ছাড়া নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ও ঐক্যফ্রন্ট নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না, মোস্তাফা মোহসীন মন্টু, সুব্রত চৌধুরী, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমসহ ২০–দলীয় জোটের নেতারা গণ-অনশনে একাত্মতা জানিয়ে বক্তব্য দেন। অবশ্য অনশনে বিএনপির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামীর কোনো নেতা উপস্থিত ছিলেন না।