খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়েছেন জানিয়ে তার চিকিৎসায় এভারকেয়ার হাসপাতালে গঠিত মেডিকেল বোর্ড দ্রুত তাকে বিদেশ পাঠানোর সুপারিশ করেছে।
ঢাকার বেসরকারি এই হাসপাতালে রোববার রাতে মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থার সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরা হয়।
মেডিকেল বোর্ডের এই চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে এখন খালেদার উন্নত চিকিৎসার কোনো সুযোগ নেই। চিকিৎসা করাতে হলে পাঠাতে হবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা জার্মানিতে।
বিদেশ পাঠাতে দেরি হলে খালেদা জিয়া মৃত্যুঝুঁকিতে পড়বেন বলেও সতর্ক করেছেন এই চিকিৎসকরা।
৭৬ বছর বয়সী খালেদা জিয়া বহু বছর ধরে আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, ফুসফুস, চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।
দুর্নীতির মামলায় কারাগারে থাকলেও গত বছরের মার্চে সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্ত হওয়ার পর কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছিল। কিছুদিন হাসপাতালে থেকে বাসায়ও ফিরে গিয়েছিলেন।
আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে গত ১৩ নভেম্বর তাকে পুনরায় এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি সেখানে ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসাধীন।
হাসপাতালে ভর্তির কয়েকদিন পর খালেদার লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার খবর ছড়ালেও তা নাকচ করে আসছিল বিএনপি। দলীয় নেত্রী প্রায় ‘জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে’ বললেও তার অসুস্থতার বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য আসছিল না।
খালেদাকে বিদেশ পাঠাতে পরিবার থেকে আবেদন এবং বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি জানানো হলেও তাতে সরকারের সায় এখনও মেলেনি।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলে আসছেন, খালেদাকে বিদেশ নিতে হলে তাকে কারাগারে ফিরে পুনরায় আবেদন করতে হবে। তবে বিএনপি চাইলে বিদেশ থেকে চিকিৎসক আনাতে পারে।
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর অসুস্থতা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার মধ্যে রোববার রাতে তার গুলশানের বাড়ির লনে সংবাদ সম্মেলনে আসেন মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা।
এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার সর্বশেষ তথ্য নিয়ে রোববার সংবাদ সম্মেলনে তার চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. এফ এম সিদ্দিকী। তিনি জানান, বিএনপি চেয়ারপারসনের লিভার সিরোসিস হয়েছে।
বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক ফখরুদ্দিন মো. সিদ্দিকী (এফ এম সিদ্দিকী) বলেন, “ম্যাডামের সিরোসিস অব লিভার (লিভার সিরোসিস)। উনার ম্যাসিভ রক্তক্ষরণ হয়েছে।”
খালেদার কোলনে রক্তক্ষরণ চেষ্টা করে আপাতত থামানো গেলেও ভবিষ্যতে তা আবার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে জানান তিনি।
“ম্যাডামের লাস্ট টোয়েন্টিফোর আওয়ার্সের মধ্যে ব্লিডিংটা হয়নি। এখন স্টেবল আছে। কিন্তু আমরা আশঙ্কা করছি, আবার উনার যদি রি-ব্লিডিং হয়, তাহলে রি-ব্লিডিংটাকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং সেটাকে বন্ধ করার মতো মিনস বা সাপোর্টিভ যে টেকনোলজি ম্যানোভার, এটা আমাদের এখানে নেই। সেক্ষেত্রে উনার ব্লিডিং (রক্তক্ষরণ) হয়ে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাবে।”
এখন খালেদার পরবর্তী চিকিৎসার জন্য বিদেশ নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই বলে দাবি করেন এই চিকিৎসক।
তিনি বলেন, “ম্যাডামের এখন যদি ‘টিপস-TIPS’ মেথড অ্যাপ্লাই করা না হয়, তাহলে আগামীতে আবার রি-ব্লিডিং হওয়ার সম্ভবনা আছে। এটা নেক্সট উইকে ৫০ পার্সেন্ট, নেক্সট ৬ সপ্তাহে ৬০ পার্সেন্ট এবং তারপরেও যদি যায়, আল্লাহ না করুক, এটা অবভিয়াস ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে।”
“এটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা যা করছি- আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টায়। এখন আমরা কিন্তু হেলপলেস ফিল করছি। এখন এরকম একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে উনি যাচ্ছেন,” বলার সময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এই চিকিৎসক।
খালেদার পরবর্তী চিকিৎসা কোন দেশে হতে পারে- প্রশ্ন করলে মেডিকেল বোর্ডের আরেক সদস্য অধ্যাপক শামসুল আরেফিন বলেন, “টিপস হাইলি টেকনিক্যাল কাজ। আমাদের দেশে টিপস করা রোগী আমি দেখিনি। যারা আমরা রোগী ডিল করি তাদের দ্বিতীয়বার তৃতীয়বার রক্তক্ষরণ হলে তাকে সারভাইভ করা খুবই ডিফিকাল্ট। সেজন্য এই সেন্টারগুলো আমেরিকা ও ইউরোপ বেইসড। ইউএসএ, ইউকে ও জার্মানি। সেখানে এসব রোগের চিকিৎসার জন্য এডভান্সড সেন্টার আছে, তারা এর চিকিৎসা করে। সেখানেও দেশব্যাপী এই রোগের সেন্টার নেই, দুই-একটা আছে।”
এক প্রশ্নের জবাবে ডা. এ এফ এম সিদ্দিকী চিকিৎসক বলেন, “আমরা মেডিকেল বোর্ড ম্যাডামের যারা ক্লোজড রিলেটিভ তাদেরকে জানিয়েছি, যারা উনার সাথে আছে তাদেরকে জানিয়েছি। আমরা উনাদের বলেছি, যত দ্রুত পারেন অ্যারেঞ্জ করেন (বিদেশ পাঠাতে), সেটা আমরা বলেছি।”
সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে তিনি বলেন, “ম্যাডামের থার্ড টাইম ব্লিডিং হয়েছে। উনার মতো এইজে হার্ট ফেইলিউর আছে, যার না কি হিমোগ্লোবিন কমে যায়, যার ডায়াবেটিক আছে। এত জটিলতার মধ্যে কিডনির ডিজিজ আছে, উনার এনাল ফেইলিওর হয়ে যায়। এটা কীভাবে আমরা সাসটেইন করব, যদি আমরা প্রেসারটা টিপস দিয়ে কমাতে না পারি। সেজন্য আমরা উন্নত চিকিৎসার জন্য সুপারিশ করেছি।
“আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, উনার পরিবারকে জানিয়েছি এবং যত তাড়াতাড়ি আপনারা অ্যারেঞ্জ করেন। কারণ এখনও টাইম আছে। উনি স্টেবল আছেন।”
দেরি করলে তা খালেদাকে নেওয়াও জটিল হয়ে পড়তে পারে বলে দাবি করেন তিনি।
সেই সময়সীমাটা কত- প্রশ্ন করা হলে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, “এটা কেউ বলতে পারবে না পৃথিবীতে।”
বাইরে থেকে চিকিৎসক এনে চিকিৎসা সম্ভব কি না- প্রশ্ন করা হলে তিনি তা নাকচ করে দেন।
“আপনি যদি বুঝে থাকেন যে টিপস টেকনোলজিটা, আপনি ইমাজিন করেন এটা ইউকের কিংস কলেজে … অর্থাৎ যুক্তরাজ্যের হাসপাতালের ওদের কোনো রোগী এরকম হয় ওরাই তাকে হেলিকপ্টারে বা ইয়ে করে ওই হাসপাতালে পাঠায়। হাইলি সিলেকটিভ। এভাবে একজন রোগীর জন্য একটা হাসপাতালকে ঢাকায় নিয়ে আসা সম্ভব নয়।”
গত ১৩ নভেম্বর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তির পর রাতে ব্যাপক রক্তক্ষরণে খালেদা জিয়া সঙ্কটজনক অবস্থায় চলে গিয়েছিলেন বলে জানান ডা. এফ এম সিদ্দিকী।
তিনি বলেন, “আমরা প্রথমে ১৪ তারিখ ৬টা ব্যান্ড করে একটার পর একটা ব্যান্ডিং করে উনার ইমিডিয়েন্ট ব্লিডিংটা (রক্তক্ষরণ) বন্ধ করতে সমর্থ হই। পরে ১৭ তারিখ আবার তার ব্লিডিং শুরু হয়। আমরা লাইফ সেভিং মেডিসিন দিয়ে তাকে কিছুটা স্টেবল করতে সমর্থ হই। ২১ তারিখে মনে হল যে উনার ব্লিডিংটা স্টপ হয়েছে। পরে ২৪ তারিখ তাকে জেনারেল ওটিতে নিয়ে এন্ডোস্কোপি করা হয়। এবার দেখা গেলো যে ম্যাসিভ ব্লিডিংটা আরেকটু নিচের থেকে হচ্ছে বলে মনে হল। এটার সোর্স পর্যন্ত আমরা যেতে পারিনি। আমরা আবার তাকে লাইভ সেভিং মেডিসিন দিয়েছি, আবার ব্লাড ট্রান্সমিশন করেছি।
“এখন বর্তমানে ম্যাডাম এমন এক অবস্থায় আছেন যে অবস্থাটা বলা হয় যে আইদার ইউ ডু সাম স্পেসিফিক সেটা হলো বিশ্বজোড়াই যখন নাকী ভেরিসেসে ব্যান্ডিয়ের পরে রিহ্যাভলিট করে তার একটাই রাস্তা আছে ট্রিটমেন্টের। ইফ ইউ সেন্ড লাইভ অব দ্যা পেসেন্ট টু নিড টু ডু টিপস(TIPS) ট্রান্সজুগুলার ইন্ট্রাহেপাটিক পোর্টটু সিস্টেমিক সাম অর্থা যে প্রেসারে ব্লাডটা ভ্যাসেলকে হাইপ্রেসারে ছিঁড়ে ফেলেছে সেটাকে একটা বাইপাস চ্যানেল করে দেয়া এবং এটা লাইফ সেভিংস।”
বর্তমানে খালেদা জিয়ার শরীরে হিমোগ্লোবিন লেভেল কেমন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখন উনার হিমোগ্লোবিন লেভেলটা প্রথমে ৫ দশমিক ৫ এ নেমে গিয়েছিল। সেটা আমরা সেটাকে চার ব্যাগ রক্ত দিয়ে ৯/১০ এর কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলাম। আবার সেটা কমে গিয়েছিল ৭ দশমিক ৮ এ। এটা মনে রাখতে হবে যে, উনার যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, এই রক্তক্ষরণের একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে অনেক রক্ত দিয়ে আপনি রক্ত দিয়ে হিমোগ্লোবিন বাড়াতে পারবেন না।”
এভারকেয়ার হাসপাতালে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের তত্ত্বাবধানে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের অধীনে খালেদার চিকিৎসা চলছে।
সংবাদ সম্মেলনে মেডিকেল বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক একিউএম মহসিন, অধ্যাপক মো. নুরউদ্দিন, অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন, ডা. মো. আল মামুন উপস্থিত ছিলেন।
জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় রায়ের আগে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বাড়ি থেকে আদালতের পথে খালেদা জিয়া, এরপর বন্দি হন তিনি।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজার পর খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের মামলায়ও তার সাজা হয়।
পুরান ঢাকার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে তিনি বন্দি থাকেন দুই বছর। এই সময়ে কিছুদিন চিকিৎসার জন্য বিএসএমএমইউতেও ছিলেন তিনি।
করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর পরিবারের আবেদনে গত বছরের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে তাকে মুক্তি দেয় সরকার। কারাগারে থেকে ছাড়া পেয়ে গুলশানের বাড়ি ফিরোজায় ওঠেন তিনি।
এরপর এই পর্যন্ত তিন বার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হলেন তিনি।