ঋণখেলাপি একটি ভোজ্যতেলের মিল কিনে সচল করতে চেয়েছিলেন হুমায়ুন কবির নামে এক ব্যবসায়ী। এজন্য ব্যাংক, প্রতিষ্ঠান এবং ওই ব্যবসায়ীর মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়। চুক্তির আলোকে তিনি কয়েক দফায় তিন কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দেন। তবে আজ অবধি প্রতিষ্ঠান বুঝে পাননি। মিলটি আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে ব্যাংক। অন্যদিকে টাকাও ফেরত পাননি হুমায়ুন কবির। সমঝোতা চুক্তির পর এ পর্যন্ত ব্যাংকটিতে তিনজন এমডি দায়িত্ব পালন করলেও কেউই এর সুরাহা করেননি। রাষ্ট্রীয় মালিকানার রূপালী ব্যাংকের বিরুদ্ধে এমন প্রতারণার অভিযোগ এনে ওই ব্যবসায়ী বলেছেন, এ ঘটনায় তিনি নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন। এখন দ্বারে দ্বারে ঘুরেও এর কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, রূপালী ব্যাংকের মিটফোর্ড রোড শাখার ভালো একজন গ্রাহক ছিল ক্রিস্টাল অয়েল রিফাইনারি মিল। নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে ৯ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত ওই মিলটির মূল মালিক ছিলেন মো. ওয়াহিদউল্লা। লোকসানে পড়ে ১৯৮৮ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৮ সালের ২ এপ্রিল ২৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা পাওনা দাবি করে তার বিরুদ্ধে দেওয়ানি মামলা করে রূপালী ব্যাংক। তবে গ্রাহকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকের মামলার বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ দেন উচ্চ আদালত। এমন টানাপড়েনের মধ্যে ২০০৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের সুদে-মূলে পাওনা গিয়ে ঠেকে ৭০ কোটি ২৯ লাখ টাকায়। ওই সময় ব্যাংকের মূল্যায়নে জমিসহ মিলটির দাম দাঁড়ায় প্রায় ১০ কোটি টাকা। আইনি প্রক্রিয়ায় পাওনা আদায়ের সম্ভাবনা কম থাকায় সমঝোতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটি হস্তান্তর করে টাকা আদায়ের উদ্যোগ নেয় ব্যাংক। ওয়াহিদউল্লাও এতে রাজি হন। এরপর হুমায়ুন কবির নামে একজন সুদ মওকুফ সুবিধার আওতায় ওয়াহিদউল্লার দেনাসহ প্রতিষ্ঠানটি কেনার জন্য ২০০৫ সালে ব্যাংকে আবেদন করেন।
২০০৬ সালের ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত রূপালী ব্যাংকের পর্ষদের ৭১১তম এবং একই বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ৭১২তম সভার সিদ্ধান্তের আলোকে ১৮ কোটি ২১ লাখ টাকা দেনা গ্রহণ সাপেক্ষে হুমায়ুন কবিরের কাছে মিলটি হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। ডাউন পেমেন্ট দেওয়ার পর মিল হস্তান্তর করার কথা ছিল। ব্যাংকের শর্তের অন্যতম ছিল, নির্ধারিত হারে ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ঋণ নিয়মিত করতে হবে। তিন বছরে ১২টি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পুরো টাকা পরিশোধ করতে হবে। আর সহায়ক জামানত হিসেবে ১২ কোটি টাকার সম্পত্তি বন্ধক রাখতে হবে। মিল পরিচালনায় রূপালী ব্যাংক নতুন করে কোনো ঋণ দেবে না। কোনো কারণে দুটি কিস্তি খেলাপি হলে এ অনুমোদন বাতিল হবে। শর্ত
মেনে নিয়ে কয়েক দফায় তিন কোটি ৪২ লাখ টাকা জমা দেন হুমায়ুন কবির। বন্ধক হিসেবে রাখেন ১২ কোটি ৩০ লাখ টাকা মূল্যমানের জমি। আর ব্যাংকের অনুরোধে ২০০৭ সালে রিট মামলা প্রত্যাহার করে নেন ওয়াহিদউল্লা। ফলে নিস্কণ্টকভাবে মিলের মালিকানা পেয়ে যায় ব্যাংক। এর মধ্যে ২০০৮ সালে মারা যান ওয়াহিদউল্লা।
হুমায়ুন কবির জানান, তিন কোটি ৪২ লাখ টাকার মধ্যে সর্বশেষ ২০০৮ সালের ৩ জুলাই জমা দেন এক কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এরপর মিলের মালিকানা হস্তান্তরের জন্য ব্যাংকে যোগাযোগ করলে নানা উপায়ে তাকে ঘুরানো হয়। এর মধ্যে হুমায়ুন কবিরকে না জানিয়ে ২০০৯ সালের ৩ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে মিলটি বিক্রির নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ব্যাংক। ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর ১৬ কোটি টাকায় মিলটিকে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের কাছে বিক্রি করা হয়। যদিও নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে ক্রিস্টাল অয়েলের দেনার পরিমাণ উল্লেখ ছিল ৫১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি আরেক জনের কাছে বিক্রি করা হলেও হুমায়ুন কবিরকে টাকা ফেরত দেওয়া হয়নি। এমনকি তাকে কোনো নোটিশও দেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান সমকালকে বলেন, ঘটনাটি বেশ আগের। ওই সময় তিনি এই ব্যাংকে ছিলেন না। যতটুকু জানতে পেরেছেন, তিন পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে সুদ মওকুফ সুবিধায় দেনা গ্রহণ সাপেক্ষে মিলটি হুমায়ুন কবিরের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে তিনি কিস্তি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় মিলটি আর তাকে দেওয়া হয়নি। মিলটি হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় হুমায়ুন কবির তিন কোটি ৪২ লাখ টাকা জমা দেওয়ার পরও তাকে নোটিশ না দিয়ে কিংবা আজও টাকা ফেরত না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে এমডি বলেন, শর্ত পরিপালন করতে না পারলে তাকে টাকা ফেরত কিংবা জানানোর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাছাড়া তিন কোটি নয়, হুমায়ুন কবির দিয়েছিলেন এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা। বাকি দুই কোটি পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিলেন ওয়াহিদউল্লা। এখন মানবিক বিবেচনায় হুমায়ুন কবিরের জমা টাকা ফেরত দেওয়া যায় কি-না বিষয়টি দেখা হচ্ছে। বিষয়টি শিগগির পরিচালনা পর্ষদে পাঠানো হবে।
রূপালী ব্যাংকের এমডির এ বক্তব্য সঠিক নয় বলে দাবি করেন হুমায়ুন কবির। হুমায়ুন কবির সমকালকে বলেন, তিনি তিন কোটি ৪২ লাখ টাকা জমা দিয়েছিলেন এবং সে তথ্যপ্রমাণ তার কাছে আছে। তাছাড়া ক্রিস্টাল অয়েলের বিষয়ে ব্যাংক এবং তার মধ্যে অন্তত ৪২টি চিঠি চালাচালি হয়েছে। এসব চিঠির অনেক জায়গায়ও তিনি তিন কোটি ৪২ লাখ টাকা দিয়েছেন বলে উল্লেখ রয়েছে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাকে বলা হয়েছিল, খেলাপি প্রতিষ্ঠান হস্তান্তর করার আগে ঋণটি নিয়মিত করতে হবে। সে আলোকে তিনি ক্রিস্টালের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করেছিলেন। তিনি বলেন, মিল চালানোর সক্ষমতা ছিল না বলেই ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে ক্রিস্টাল অয়েল বন্ধ ছিল। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা রুগ্ণ প্রতিষ্ঠান তার সমঝোতা প্রক্রিয়ার মধ্যে কেন হঠাৎ করে ওয়াহিদউল্লা টাকা দেবে। এটা ব্যাংকের অযৌক্তিক বক্তব্য।
হুমায়ুন কবির জানান, তার ১৮ কোটি ২১ লাখ টাকায় মিল বিক্রির প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন হয়েছিল। এ সময়ে আরেক প্রতিষ্ঠানের কাছে ১৬ কোটি টাকায় কেন বিক্রি করা হলো তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তিনি বলেন, ওই সময় ইনিয়ে-বিনিয়ে তার কাছে কিছু টাকা চাওয়া হয়েছিল। তবে দিতে রাজি না হওয়ায় একবার রূপালী ব্যাংকের আঞ্চলিক কার্যালয়ের তৎকালীন প্রধান আবুল হোসেন এবং মিটফোর্ড শাখার ব্যবস্থাপক আ আ ম ফেরদৌস সরকার সরাসরি তার কাছে উৎকোচ চান। টাকা দিতে না পারায় তাকে আজ এ কাগজ, কাল ওই কাগজ চেয়ে ঘুরানো হচ্ছিল। আবুল হোসেন এবং ফেরদৌস সরকার তাকে বলতেন, প্রধান কার্যালয়ের উচ্চপদস্থ স্যারদের টাকা দিলে দ্রুত প্রতিষ্ঠান বুঝে পাবেন। তবে মিল বুঝে পাওয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে আসায় তিনি আর বাড়তি কোনো খরচ করতে চাননি। আবার বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ধার-দেনা করে তিন কোটি ৪২ লাখ টাকা দেওয়ার পর তার কাছে কাউকে দেওয়ার মতো টাকাও ছিল না।
ঢাকা দক্ষিণ অঞ্চলের আঞ্চলিক কার্যালয়ের তৎকালীন প্রধান আবুল হোসেন বেশ আগে অবসরে গেছেন। আর আ আ ম ফেরদৌস সরকার অন্য একটি শাখার দুর্নীতির ঘটনায় ২০১২ সালে চাকরিচ্যুত হন। নানা উপায়ে চেষ্টা করে এ দু’জনের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তারা কোথায় আছেন সে তথ্যও জানা যায়নি। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক তাদের খে?াঁজ পাচ্ছে না।
হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে সমঝোতা প্রক্রিয়ার মধ্যে গোপনে মিলটিকে গ্রুপের কাছে বিক্রির সময় রূপালী ব্যাংকের এমডি ছিলেন মো. আব্দুল হামিদ মিঞা। জানতে চাইলে তিনি সমকালকে বলেন, ‘বহু আগের ঘটনা। ওই সব পুরান কথা মনে নেই।’ আব্দুল হামিদ মিঞার পরে ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এমডির দায়িত্ব পালন করা এম. ফরিদ উদ্দিনও একই কথা বলেন।
টিকে গ্রুপের এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, ২০০৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর টিকে গ্রুপ ক্রিস্টাল অয়েল রিফাইনারি মিল কিনে নিলেও আজ অবধি তা সচল করতে পারেনি। নয় বিঘা জমির মধ্যে ছয় বিঘা জমির দীর্ঘদিন খাজনা অপরিশোধিত থাকায় তা সরকারি সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। যদিও নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরের এ জায়গা বর্তমানে টিকে গ্রুপের দখলে রয়েছে।
প্রায় এক যুগ ধরে জমা টাকার ওপর সুদসহ আট কোটি টাকা এবং বন্ধকি সম্পত্তির কাগজ ফিরে পেতে হুমায়ুন কবির ব্যাংক, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরেও সুরাহা পাননি। দফায় দফায় তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৯ জুলাই পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়। যদিও আজ অবধি সেই তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। এর মধ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বরে হুমায়ুন কবির তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী, বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের দ্বারস্থ হন। মন্ত্রী তার আবেদনের ওপর ‘গুরুতর অভিযোগ, খতিয়ে দেখা প্রয়োজন এবং বিহিত ব্যবস্থা নেওয়াও প্রয়োজন’ লিখে গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর তা ব্যাংকের এমডি বরাবর পাঠিয়ে দেন।
ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য এবং সমঝোতা প্রক্রিয়া শুরুর দিকে ২০০৫ সালে রূপালী ব্যাংকের মিটফোর্ড শাখার ব্যবস্থাপক ছিলেন পেয়ার আহমেদ ভূঁইয়া। বর্তমানে তিনি প্রধান কার্যালয়ের ঋণ আদায় বিভাগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত। গত ২৭ মার্চ এ বিষয়ে তার কার্যালয়ে বসে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, সমঝোতা প্রক্রিয়ায় হুমায়ুন কবির মিল কেনার জন্য টাকা দিয়েছিলেন সেই রেকর্ড ব্যাংকে আছে। কিস্তির টাকা যেভাবে পরিশোধ করার কথা, সেভাবে না দেওয়ায় হয়তো মিলের মালিকানা পাননি। তবে হুমায়ুন কবিরকে কোনো ধরনের নোটিশ না দিয়ে অন্য জায়গায় কেন মিল বিক্রি করা হলো, তা তার কাছেও পরিস্কার নয়। অন্য জায়গায় বিক্রির পরও তাকে এতদিনে কেন টাকা ফেরত দেওয়া হয়নি, তাও তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি আবুল হোসেন এবং আ আ ম ফেরদৌস সরকারকে অনেক খুঁজেছে। তবে তারা কোথায় কীভাবে আছেন, তা জানতে পারেননি। তাদের পাওয়া গেলে ঘটনা নিষ্পত্তি সহজ হতো।
রূপালী ব্যাংকের মিটফোর্ড শাখার ওই সময় ডিলিং অফিসারের দায়িত্বে থাকা মাকসুদুর রহমান বর্তমানে ব্যাংকটির ধানমণ্ডি শাখার ব্যবস্থাপক। তিনি সমকালকে বলেন, মিল হস্তান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে তখন কয়েক বছর ধরে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা হয়েছিল। জামানতি সম্পত্তি যাচাই-বাছাই করতে সময় লাগছিল। এর মধ্যে আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে নিলাম ডেকে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, সমঝোতা প্রক্রিয়ায় মিল না দিলে কেন স্বাভাবিকভাবে তাকে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা। এরকম কেন হয়েছে, তা দেখা হবে।