দীর্ঘ টানাপোড়েন ও মতভেদ কাটিয়ে উঠে শিগগিরই নতুন কমিটি গঠন করতে যাচ্ছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম। চলতি মাসের শেষে অথবা মার্চের প্রথম সপ্তাহে রাজধানী ঢাকায় দলটির প্রতিনিধিসভা অনুষ্ঠিত হবে।
সেখানে এই কমিটি গঠন করা হবে। এর আগে দলের শীর্ষ নেতারা বৈঠকে বসে দলের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ঠিক করবেন। আপাতত জোটগত নয়, এককভাবেই পথচলার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন। গণফোরামের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে ২০১৯ সালের ২৬ মে অনুষ্ঠিত গণফোরামের কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে দলটিতে টানাপোড়েন তৈরি হয়। ওই সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে মোস্তফা মহসিন মন্টুকে সরিয়ে দলের নবাগত ড. রেজা কিবরিয়াকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর থেকেই বহিষ্কার, পালটা বহিষ্কারের পথ ধরে ভাঙনের মুখে হাঁটতে থাকে গণফোরাম।
সম্মেলনের পরপরই দলটির শীর্ষ নেতারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে আলটিমেটাম দিয়ে আলাদা আলাদা কাউন্সিল আয়োজনেরও উদ্যোগ নেয়। এ অবস্থায় ড. রেজা কিবরিয়াকে সরিয়ে দেওয়াসহ কমিটি বাতিল করে দিয়ে ড. কামাল হোসেন ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেন তার দলকে।
জানতে চাইলে ড. কামাল হোসেন মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের ভেতরে কিছু সমস্যা ছিল। ইতোমধ্যে আমরা এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠেছি। গণফোরামের সবাই ঐক্যবদ্ধ আছে, আগামী দিনেও ঐক্যবদ্ধ থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির একটু উন্নতি হলে এ মাসের শেষদিকে অথবা আগামী মাসের প্রথমদিকে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে বসব। সারা দেশের নেতাকর্মীরা আসবেন। সবার মতামতের ভিত্তিতে কমিটি গঠন করা হবে। একই সঙ্গে আমরা আমাদের পরবর্তী করণীয়ও ঠিক করব।’
গণফোরামের একাধিক নেতার মতে, বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন, জামায়াতে ইসলামীকে মেনে নিয়ে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে আসন ভাগাভাগিসহ রাজনৈতিক ইস্যুতে পুরোনো সংকট ছিল দলটিতে।
এর সঙ্গে যোগ হয়, ড. রেজা কিবরিয়াকে দলের সাধারণ সম্পাদক করা। ফলে অভ্যন্তরীণ সংকট দানা বেঁধে ওঠে গণফোরামে। দলের ভেতরেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন।
গঠনতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড, ব্যক্তিস্বার্থে অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী কায়দায় দল পরিচালনার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। এছাড়া দলের নীতি, আদর্শ, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য বিসর্জন দিয়ে বিএনপি-জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে ঐক্য করার অভিযোগ আনা হয় ড. কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে।
গণফোরামের ছয় শীর্ষ নেতা তার বিরুদ্ধে লিখিতভাবে এসব অভিযোগ উত্থাপন করেন। নেতারা হলেন-দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মফিজুল ইসলাম খান কামাল, জামাল উদ্দিন আহমেদ, অ্যাডভোকেট এসএম আলতাফ হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার সিরাজুল হক এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এএ মাহমুদ। ছয় শীর্ষ নেতাই গণফোরামের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য এবং প্রথম থেকেই ড. কামাল হোসেনের রাজনৈতিক সঙ্গী।
তারা ২৬ এপ্রিল মহানগর নাট্যমঞ্চে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কাউন্সিল শেষে গঠিত কমিটিকে ‘অগণতান্ত্রিক এবং অনৈতিকভাবে গঠিত’ বলে দাবি করেন। তারা দ্রুত এ কমিটি ভেঙে দেওয়ারও দাবি জানান। অন্যথায় ভিন্ন পথ দেখবেন বলেও জানিয়ে দেন। এ অবস্থায় গণফোরামে যোগদানের দেড় বছরের মাথায় দলটি ছাড়ার ঘোষণা দেন ড. রেজা কিবরিয়া।
রোববার পদত্যাগপত্র গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। দল ছাড়ার পর দেশে থাকলেও অন্য কোনো দলে যোগ দেওয়ার কথা এখনো ভাবেননি বলে জানিয়েছেন ড. রেজা কিবরিয়া। তবে তিনি জানিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর নিজের করণীয় জানান দেবেন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করলে ওই সময় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন শাহ এএমএস কিবরিয়া। তার একমাত্র ছেলে ড. রেজা কিবরিয়া ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আকস্মিকভাবে দেশে ফেরেন। গণফোরামে যোগ দিয়ে রাজনীতিতে নাম লেখান।
ওই নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে অংশ নেয় গণফোরাম। ড. রেজা কিবরিয়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের হয়ে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে হবিগঞ্জে বাবার আসনে প্রার্থীও হন, যদিও তিনি জয়লাভ করতে পারেননি।
যোগ দেওয়ার পর গণফোরামের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য করা হয়েছিল ড. রেজা কিবরিয়াকে। নির্বাচনের পর তাকে সাধারণ সম্পাদক করেন ড. কামাল হোসেন। এ নিয়ে গণফোরামে দেখা দেয় বিরোধ। চলে বহিষ্কার-পালটা বহিষ্কার।
মোস্তফা মহসিন মন্টুসহ একাংশ ক্ষুব্ধ হয়ে দল ভাঙার উদ্যোগও নেন। এমন পরিস্থিতিতে ড. কামাল হোসেন দুই পক্ষকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার উদ্যোগ নেন সম্প্রতি।
এ প্রসঙ্গে দলটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের মধ্যে যেসব সমস্যা ছিল, তা ইতোমধ্যে অনেকটাই সমাধান হয়েছে। আমরা সবাই বসে পরবর্তী করণীয় ঠিক করব।’