পৃথিবীর প্রথম জাতীয় সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান হলো ‘ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন’ (বিবিসি)। এটি ১৪ নভেম্বর ১৯২২ সালে রেডিও স্টেশন 2LO থেকে প্রথম বেতার বুলেটিন সম্প্রচার করে। বর্তমানে টেলিভিশনের পাশাপাশি অনলাইন নিউজ হিসাবে এটি সেবা দিয়ে আসছে বিশ্ব জুড়ে। বিশ্বজুড়ে ৫০টি বিদেশী সাব স্টেশনের মাধ্যমে প্রায় ২৫০ জনেরও বেশি প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কাজটি করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। জেমস হার্ডিং ২০১৩ সাল থেকে বিবিসি নিউজের সংবাদ এবং সাম্প্রতিক বিষয় পরিচালনা করছেন। গত এক দশকে বিবিসির সর্বাধিক পঠিত ১০টি সংবাদ নির্বাচন করেছে সংস্থাটি। পাঠকদের জন্য সেটি ভাবানুবাদ করা সংক্ষিপ্ত অংশ প্রকাশ করা হলো।
চিলির খনি শ্রমিক উদ্ধার-২০১০
দুই মাসের বেশি মাটির সাতশো মিটার গভীরে আটকে থাকা ৩৩ জন খনি শ্রমিককে সাফল্যের সঙ্গে উদ্ধার করে চিলির দমকল বাহিনী। টানা ৬৯ দিনের রুদ্ধশ্বাস সফল উদ্ধার অভিযানের জন্য চিলির সরকারকে অভিনন্দন জানায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দ। চিলির প্রেসিডেন্ট সেবাস্টিয়ান পিনেরা বলেছিলেন, যা ঘটেছে তা বিশ্বের কাছে চিলির ভাবমূর্তি বদলে দেবে। খনির নীচে আটকে পড়ার পর প্রথম দিনগুলোতে উদ্ধার পাওয়ার কোন আশাই যখন ছিল না তখন খনি শ্রমিকদের সংগঠিত করে মনোবল চাঙ্গা রাখার কৃতিত্ব এই লুই উরযুয়ার। এই সংবাদটি ২০১০ সালের বিবিসির সর্বোচ্চ পঠিত সংবাদ।
২০১১ সালে আগস্ট মাসে ইংল্যান্ডের শহর ম্যানচেস্টার, উলভারহ্যাম্পটন আর ওয়েস্ট ব্রমউইচে ব্যাপক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিলো। এতে লন্ডনের রাজপথে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৬ হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এ সময় কমপক্ষে ৪৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। লন্ডনের বাইরে নয়টি এলাকা থেকে পুলিশ বাহিনী লন্ডনে আসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মেট্রোপলিটান পুলিশকে সহায়তা করার জন্য। লন্ডনের বিভিন্ন এলাকায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটতে থাকে উত্তরে এনফিল্ডে সোনি কোম্পানির একটি গুদাম, দক্ষিণ-পূর্বের উলইচের একটি শপিং মল, পূর্ব লন্ডনের ইস্টহ্যামের একটি কাঠের গুদাম আর দক্ষিণ-পশ্চিমের ল্যাভেন্ডার হিলে একটি ভবন দক্ষিণ-পূর্বের পেকহ্যামে একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রিনে একশ’র মত যুবক টেসকো সুপারমার্কেট লুট করে। পশ্চিম লন্ডনের ইলিং-এ দোকান-পাট এবং রেস্তোঁরায় ব্যাপক ভাংচুর হয়। সে সময় দাঙ্গার কারণে বেশ কয়েকটি ফুটবল ম্যাচ বাতিল করা হয়। দাঙ্গার মূল কারণ ছিলো পুলিশের গুলিতে এক তরুণের মৃত্যু।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামার ফিরে আসা- ২০১২:
২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়েছিলেন বারাক ওবামা। দেশের দুই শতাব্দীর বেশি সময়ের ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রবেশ করেছিলেন হোয়াইট হাউসে। ২০১২ সালে ০৭ নভেম্বর গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বী মিট রমনির চেয়ে এগিয়ে থেকে দ্বিতীয় মেয়াদে চার বছরের জন্য নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। সমীহজাগানো ব্যবধানে রিপাবলিকান চ্যালেঞ্জারকে হারান বারাক ওবামা। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ (নির্বাচকমণ্ডলী) ভোটের মধ্যে তিনি পেয়েছিলেন ৩০৩টি। ওবামার প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী মিট রমনি পেয়েছিলেন ২০৬ ভোট। এই সংবাদটি বিবিসির ২০১২ সালের সব থেকে বেশি মানুষ পড়েছে।
বোস্টনে বোমা হামলা-২০১৩:
জোখার সারনায়েভ এবং তার ভাই তামেরলান সারনায়েভ মিলে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে বোস্টন ম্যারাথন চলার সময় প্রেশার কুকার বোমা হামলা চালান। সে সময় তিনজন নিহত ও আহত হয়েছিল অন্তত ২৬০ জন।
হেরোইনে আসক্ত ২৫ বছর বয়সী পিচেস গেল্ডফের মৃত্যু সকলকে হতবাক করে দিয়েছিলো। মূলত এই তরুণী হেরোইনে আসক্ত হওয়ায় পর এক পর্যায়ে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র থেকে সুস্থ্য হয়ে ফেরেন। এরপর বাড়ি ফিরে মৃত্যুর আগে আবারও তিনি হেরোইন সেবন শুরু করেন বলে জানায় পিচেসের স্বামী। সনামধন্য মিউজিশিয়ান বব গেলডফের মেয়ে পিচেসের মৃত্যু সকলের মনে দাগকাঁটে। ব্যক্তিগত জীবনে একজন কলামিস্ট ও মডেল এই নারীর মৃত্যুতে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ সে সময় শোক বার্তা লিখে মন্তব্য করেন।
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে হামলা-২০১৫:
১৩ই নভেম্বর ২০১৫ তারিখের সন্ধ্যায় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস ও রাজধানীর ঠিক উত্তরে সাঁ-দ্যনি শহরে ধারাবাহিক ও সমন্বিত সন্ত্রাসী আক্রমণ ঘটে যেখানে হত্যা করা হয় ১৩০ জনকে। আক্রমণটি আত্মঘাতী বোমা হামলা, বোমা হামলা ও জিম্মি করে হত্যার মাধ্যমে করা হয়। কেন্দ্রীয় ইউরোপীয় সময় রাত ৯টা ১৬ মিনিটে সাঁ দ্যনির শহরের উত্তর শহরতলীতে স্তাদ দ্য ফ্রঁস ক্রীড়াক্ষেত্রের বাইরে তিনটি পৃথক আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং কেন্দ্রীয় প্যারিসের কাছাকাছি চারটি ভিন্ন স্থানে জিম্মি করে হত্যা ও আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাটি হয় বাতাক্লঁ নাট্যশালাতে যেখানে আক্রমণকারীরা সেখানে থাকা নাগরিকদের জিম্মি করে। পরে পুলিশ ভারী অস্ত্রসহ সেখানে অভিযান চালায় যা শেষ হয় স্থানীয় সময় ১৪ নভেম্বর রাত ১২টা ৫৮ মিনিটে। ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ট (আইএসআইএল) এই হামলার দায় স্বীকার করে।
ঐতিহাসিক ব্রেক্সিট গণভোটে ব্রিটেনের বেশীরভাগ মানুষ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে ভোট দেয় এ বছর। গণভোটের এই ফলাফলের কারণে ৪৩ বছর পরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশটি। গণভোটের ফলাফলে দেখা যায়, ৫২ শতাংশ ব্রিটিশ নাগরিক ইইউ ত্যাগের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা না থাকার এই ভোট, যাকে ব্রেক্সিট হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছিল, তাতে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের বেশীরভাগ মানুষ ইউরোপ ছাড়ার পক্ষে রায় দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত ইউকেআইপি’র নেতা নাইজেল ফারায গণভোটের ফলাফলকে ‘স্বাধীনতা দিবস’ বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন সে সময়।
শুরু থেকেই ব্রেক্সিট নিয়ে যুক্তরাজ্যের জনগণের মধ্যে ভোটের আগ্রহ থাকলেও পরবর্তীতে তা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ব্রেক্সিটের জন্য গণভোট এবং তাকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুনের পদত্যাগের পর পার্লামেন্টের অভ্যন্তরিন নির্বাচন এবং পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে ব্রেক্সিটের পক্ষে বিপক্ষে অগণিত ভোটের রাজনীতিতে ক্লান্ত ছিলো ব্রিটেনবাসী। মাত্র তিনটি কথায় ব্রেন্ডা কয়েক মিলিয়ন ভোটারদের চিন্তাভাবনা সংক্ষিপ্ত করে রেখেছিলেন। এই সংবাদটি বিবিসির লাইভ কভারেজে ছিল ওই বছরের সর্বাধিক পঠিত।
অনেক ভোট, আলোচনা, পর্যালোচনা ও সমালোচনা শেষে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টে যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন থেরেসা মে। ২০১৮ সালের সবচাইতে আলোচিত সংবাদ ছিলো এটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার এই আলোচনার পরও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। আর সে কারণেই পদত্যাগ করেন থেরেসা মে।
যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচন-২০১৯:
যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে ১৯৩৫ সালের পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত লেবার পার্টির জন্য সব থেকে বাজে নির্বাচন বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে চলতি বছরে কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া ব্রিটিশ নির্বাচনকে। এটিকেও অনেকে ব্রেক্সিট গণ ভোট হিসেবে অ্যাখ্যা দিচ্ছেন। কারণ ব্রেক্সিট প্রস্তাবে বিভক্ত যুক্তরাজ্য শেষ পর্যন্ত কনজারভেটিভ পার্টিকে বেছে নেয়। আশির দশকের পর এটি ছিলো কনজারভেটিভ পার্টির সবচাইতে বড় জয়। ‘যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে সবকিছু বদলে গেছে’-দেয়া এই নির্বাচনের সংবাদ ছিলো চলতি বছরের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ।