ছোটবেলায় চুলে তেল দিতে চাইতাম না। আম্মু চুলে তেল লাগিয়ে দিলেই পরের দিন শ্যাম্পু করে ফেলতাম। বকুনিও কম খাইনি এ কারণে। তখন আমাদের একতলা বাড়ি। আম্মু-আব্বুর ঘরে খাটের পেছনে মাথার কাছের জানালা দিয়ে যে জায়গাটা দেখা যায় ওটা মূলত বাড়ির বর্ধিতাংশ, কলপাড়। সেখানে বাসন থেকে শুরু করে কাপড় সবই ধোয়া হতো।
আব্বু সেখানেই স্নান করতেন। দুপুরে ভাতঘুমের সময়টায় সে জানালাটা আব্বু খোলা রাখতেন, ভালো হাওয়া আসতো বলে। ছোটবেলায় প্রায়ই বিকেলেই আমি ঘুমাতাম না। একমনে খেলতাম। তবে এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে আব্বুর পাশে শুয়ে পড়তাম কখনও। আসরের আজান দিলে আব্বু উঠে পড়তেন, আমি টের পেতাম না।
নামাজের পর মাঝেমধ্যে যে কাজটা করতেন সেটা খুবই বিরক্তিকর ছিল আমার জন্য। প্রায়ই বিকেলে ঘুম ভেঙে দেখতাম আব্বু আমার চুলে তেল দিয়ে দিয়েছেন। আবার কখনও দেখতাম মাথার একপাশে তেল দেওয়া, অন্যপাশে তেল নেই। মানে হয়ত আমি বাম কাঁত হয়ে ঘুমাচ্ছিলাম তখন ডানপাশের অংশের চুলে তেল মাখিয়েছেন তিনি। ওপাশে তেল মাখার আর সুযোগ পাননি। আয়নায় নিজের এমন অবস্থা দেখে ওই বয়সে সবার কান ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে হতো। হট্টগোলও কম কিরেছি বলে মনে হয় না। একটু বড় হওয়ার পর অবশ্য অবস্থার পরিবর্তন হলো।
ক্লাস ফাইভে যখন উঠলাম, তখন চট্টগ্রাম থেকে একবার আমার বড়বোন এলো। আব্বু-আম্মুর জন্য নিয়ে এলো ভাটিকা হেয়ার অয়েল। কী সুন্দর ঘ্রাণ তেলের, আবার মাথা ঠান্ডাও হয়ে যায়! আব্বুর রাতে ঘুম হতো না ভালো। ঘুমানোর আগে মাথার চাঁদিতে দেয়ার জন্য এ এনেছিল আমার বোন। এতে মাথা ঠান্ডা হবে আর আব্বু ঘুমাতেও পারবে। কিন্তু ওই তেল আমার দেওয়া নিষেধ ছিল। কারণ ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। তবে মাঝেমধ্যে পড়ার সময় মাথা ঘুরাচ্ছে এই বাহানায় ওই তেল দেওয়ার সুযোগ পেতাম।
ভাটিকার ঘ্রাণটাই আমাকে টানতো মূলত। সেসময় আম্মু চুলের তেল দেওয়ার কথা বললেই বলতাম, যদি ভাটিকা দিতে দাও তাহলে তেল দেবো, নয়তো না। আম্মু তখন অকারণ বকবক করতো। কিন্তু তার মনে হতো তিনি যৌক্তিক কথা বলছেন। আব্বু আম্মুকে বলতো, দাওনা কি হবে দিলে। তখন আব্বু বসতেন খাটের ওপর আর আমি রান্নাঘর থেকে মোড়া এনে খাটের কাছে আব্বুর সামনে বসতাম। আব্বু পেছন থেকেই আমার মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি করে চুলকে দুইভাগ করতেন। তারপর এক-এক পাশ করে তেল লাগাতেন। বলতেন, তেল হচ্ছে চুলের খাবার। তুমি না খেলে যেমন পুষ্টি পাবে না তেমনি চুলও তেল না পেলে পুষ্টি না পেয়ে নষ্ট হয়ে যাবে।
মাঝেমধ্যে তেল দিতে দিতে একটা হিন্দি গানও গাইতেন আব্বু। তখন জানতাম না গানটা আসলে কার বা কোন সিনেমার। গানটা হচ্ছে- ‘চান্দনি জেইসা রাঙ হ্যায় তেরা, সোনে জেইসে বাল/ এক তুহি ধানবান হ্যায় গোরি, বাকি সাব কাঙ্গাল।’
আব্বু আজ নেই। তিন বছরের বেশি সময় পার হয়েছে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ওপারে। সেদিন চুলে তেল দেওয়ার সময় আব্বুর কথা মনে পড়লো, নাকে এসে লাগলো ভাটিকা হেয়ার অয়েলের সেই গন্ধটা। এ গানটার কথাও মনে হচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ইউটিউবে খুঁজলাম, দেখলাম গানটি গেয়েছেন পংকজ উদাস। ‘এক হি মাকসাদ’ চলচ্চিত্রের গান এটি। চলচ্চিত্রটি ১৯৮৮ সালে মুক্তি পায়।
আমার এখনো চুলে তেল দিতে ইচ্ছে করে না আব্বু। মাঝে মাঝে আম্মুর কাছে গেলে আম্মু দিয়ে দেয়। তোমার ঘরের স্টিলের আলমারির পকেটে এখনো দুটো ভাটিকা হেয়ার অয়েল আছে। আম্মু সেগুলো কী করবে জানি না…। তুমি ভালো থেকো, অনেক ভালো।