সব ধরনের প্রস্তুতি শেষেও নির্বাচনের কারণে গত বছর গ্যাসের দাম বাড়ায়নি সরকার। এখন নতুন করে দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সব খাতে গ্যাসের দাম গড়ে ৬৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। এ ছাড়া গ্যাস সঞ্চালন মাশুল বৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছে গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (জিটিসিএল)। এসব প্রস্তাবের ওপর মার্চের ১১ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত গণশুনানির আয়োজন করবে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
মূলত আমদানি করা তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) কারণে এ খাতের ব্যয় বেড়েছে। যা সমন্বয়ের জন্যই গ্রাহক পর্যায়ে দাম বৃদ্ধির এ উদ্যোগ। সূত্রমতে, নতুন প্রস্তাবে বাসা-বাড়িতে দুই বার্নার চুলার গ্যাসের দাম ৮০০ থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ২০০ টাকা এবং এক বার্নারের দাম ৭৫০ থেকে বৃদ্ধি করে এক হাজার টাকার কথা বলা হয়েছে। আবেদন গৃহীত হলে আবাসিক ছাড়াও দাম বাড়বে বিদ্যুৎকেন্দ্র, ক্যাপটিভ পাওয়ার, সিএনজি, শিল্প ও সার কারখানায় ব্যবহূত গ্যাসের দাম।
গত বছরের আগস্ট থেকে দেশীয় গ্যাসের পাশাপাশি আমদানি করা এলএনজির ব্যবহার শুরু হয়। এলএনজির আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় লোকসান হবে- এমন যুক্তিতে গত মার্চ মাসেই বিতরণ ও সঞ্চালন কোম্পানিগুলো গ্রাহক পর্যায়ে ১২০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বৃদ্ধির আবেদন করে। গত জুন মাসে তাদের প্রস্তাবের ওপর গণশুনানির আয়োজন করে বিইআরসি। সব হিসাব বিবেচনা নিয়ে বিইআরসি জানায়, প্রতি ঘনমিটারে ২০ দশমিক ৩৬ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। সামনে নির্বাচনের কথা বিবেচনা করে সরকার দাম বৃদ্ধির বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করে। পরে কমিশন দাম না বাড়িয়ে সরকারকে গ্যাস খাতে ভর্তুকি দেওয়ার পরামর্শ দেয়। বিতরণ কোম্পানিগুলোর লোকসান কমাতে সরকারও এলএনজি সরবরাহ পর্যায়ের ভ্যাট বাদে আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে সব ধরনের শুল্ক্ক ও কর প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। একই সঙ্গে চলতি অর্থবছরে প্রায় তিন হাজার ১০০ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। এসব কারণে গত ১৬ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে গ্যাসের আগের দামই বহাল রাখার ঘোষণা দেয় কমিশন। বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের গড় মূল্য সাত টাকা ১৭ পয়সা।
সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের চেয়ে এলএনজির সরবরাহ বেড়েছে। গত বছর গড়ে দৈনিক ৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হলেও এখন তা ৪৫ কোটি ঘনফুটে পৌঁছেছে। আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে আরও ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি জাতীয় গ্রিডে যোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সব মিলিয়ে গ্যাসের দাম না বাড়লে লোকসান গুনতে হবে বলে দাবি করছে বিতরণ কোম্পানিগুলো।
সূত্র জানিয়েছে, এলএনজি সরবরাহ ১০০ কোটি ঘনফুটে পৌঁছালে শুধু এ খাতেই সরকারকে বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হবে। কর ও শুল্ক্ক প্রত্যাহারের ফলে এই ব্যয় কমলেও তা ১০ হাজার কোটি টাকার নিচে নামবে বলে জানিয়েছেন জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা জানান, প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ৩২ টাকা দরে আমদানি করে সাত টাকা ১৭ পয়সা দরে বিক্রি করার কারণে গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। শুধু গত বছর অক্টোবরেই সরকার এলএনজিতে ভর্তুকি দিয়েছে ৫৬০ কোটি টাকা।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারি মাসের শেষদিকে পাঁচটি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি আবাসিক, শিল্প, বাণিজ্য, বিদ্যুৎসহ সব খাতেই দাম বাড়ানোর আবেদন করেছে। তাদের আবেদনের ওপর আগামী ১১ থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম দিন জিটিসিএলের সঞ্চালন মাশুল বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এর পর তিন দিন বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানির আয়োজন রয়েছে।
শিল্প উদ্যোক্তারা বলেছেন, বর্তমানের প্রতিযোগিতার বাজারে গ্যাসের দাম আবার বাড়ানো হলে শিল্প কারখানা টিকতে পারবে না। কারণ এতে শিল্পপণ্যের উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়বে। এর সার্বিক প্রভাব পড়বে শিল্পায়ন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর।
এ বিষয়ে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সদ্য বিদায়ী সভাপতি তপন চৌধুরী গত মাসে সমকালকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের বিষয় হলো গ্যাসের দাম। অত্যন্ত ব্যয়বহুল জ্বালানি এলএনজির আমদানি বাড়ছে। ফলে সরকারকে একটা পর্যায়ে গ্যাসের দাম সমন্বয় করতে হবে। কিন্তু গ্যাসের দাম বৃদ্ধি শিল্পের জন্য সহায়ক হবে না। তিনি বলেন, শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এ ক্ষেত্রে সরকারকে ভর্তুকি দিতেই হবে। আমরা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছি, গ্যাসের দর একবারে না বাড়িয়ে যেন বছরে ৩ থেকে ৪ ধাপে বাড়ানো হয়, যেটা শিল্পের জন্য মোটামুটি সহনীয় হবে। উদ্যোক্তারা পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সময় পাবেন।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়। সে বছরের মার্চ ও জুলাই থেকে দুই ধাপে তা কার্যকর হয়।