দেশের দুই শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবি এবং বিটিআরসির মধ্যকার বিরোধ অবসান হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
তিনি বলেছেন, কিছু বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝি ছিল। দু’পক্ষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। সরকারের বকেয়া টাকা নিয়ে তিন সপ্তাহের মধ্যে গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে উভয় পক্ষ ঐকমত্য হয়েছে।
বুধবার সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। এর আগে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বৈঠক হয়।
বৈঠকে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব অশোক কুমার বিশ্বাস, বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক, গ্রামীণফোনের সিইও মাইকেল ফোলি এবং রবির সিইও মাহতাব উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন অর্থমন্ত্রী।
এদিকে, অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে মোবাইল ফোন অপারেটররা বলেছে, এর মধ্য দিয়ে টেলিযোগাযোগ খাতে সৃষ্ট বিরূপ পরিস্থিতির অবসান হবে, যা এই শিল্প-সংশ্নিষ্ট সবার জন্য স্বস্তি বয়ে আনবে।
অর্থমন্ত্রী জানান, পাওনা টাকার বৈধতা নিয়ে গ্রামীণফোন ও রবি সরকারের বিরুদ্ধে যে মামলা করেছে, তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। এ ছাড়া সরকারের সংশ্নিষ্ট সংস্থার পক্ষ থেকে এরই মধ্যে অপারেটরের বিরুদ্ধে যেসব শোকজ নোটিশ করা হয়েছে, তা তুলে নেওয়া হবে। এর ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ বছর ধরে যে বিরোধ তৈরি হয়, তা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলে আশা করেন অর্থমন্ত্রী।
জানা যায়, বিটিআরসির দাবি অনুযায়ী গ্রামীণফোন ও রবির কাছে সংস্থাটির মোট পাওনা ১৩ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের কাছে ১২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। বাকি ৮৬৭ কোটি টাকা রবির কাছে। এই টাকা আদায়ে বিটিআরসি এবং উল্লিখিত দুই মোবাইল অপারেটরের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে বিরোধ চলে এলেও কোনো নিষ্পত্তি হয়নি।
গ্রামীণফোন দাবি করেছে, যে অডিটের ভিত্তিতে বিটিআরসি অর্থ দাবি করেছে, তা অযৌক্তিক। এভাবে অর্থ দাবির বৈধতা নিয়ে জেলা দায়রা জজ আদালতে মামলা করে গ্রামীণফোন ও রবি।
অন্যদিকে, পাওনা টাকা আদায়ে ব্যান্ডউইথ সীমিত করা এবং প্যাকেজ ও সরঞ্জামের ছাড়পত্র দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল বিটিআরসি। তাতে কোনো কাজ না হওয়ায় গত ৫ সেপ্টেম্বর দুই অপারেটরকে লাইসেন্স (টুজি ও থ্রিজি) বাতিল কেন করা হবে না, তা জানতে চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। এসব নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিরোধ চলছে দুই শীর্ষ ফোন অপারেটরের। গণমাধ্যমে এ নিয়ে লেখালেখির কারণে গ্রামীণফোনের শেয়ারের দামে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা।
এ বিষয় সমাধানে বুধবার দুই মোবাইল অপারেটরের সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যদিও প্রথমে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল বিটিআরসিতে। কিন্তু পরে তা পরিবর্তন করে অর্থমন্ত্রীর দপ্তরে আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, পাওনা নিয়ে সরকারের সঙ্গে বহুকাল ধরে বিতর্ক চলছে। বিষয়টি নিষ্পত্তি নিয়ে কারও মধ্যে সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই। সরকার মনে করেছে, এর জরুরি সমাধান করা উচিত। সে জন্য সমাধানের পথ খুঁজতে বৈঠক ডাকা হয়।
তিনি আরও বলেন, এর আগে কয়েক দফা বৈঠক হলেও কোনো ফল আসেনি। বুধবারের বৈঠকে চলমান বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে বলে জানান তিনি।
এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, গ্রামীণফোন ও রবি সরকারকে নিয়মিত ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে আসছে। পাওনা নিয়ে যে বিরোধ রয়েছে, তার মধ্যে এনবিআরের অংশ চার হাজার কোটি টাকা। মামলা-মোকদ্দমায় না গিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে এই টাকা আদায় করা হবে বলে জানান তিনি।
এনবিআর চেয়ারম্যান আরও জানান, বিটিআরসির পাওনা আট হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ হচ্ছে সুদ। এনবিআর যে পরিমাণ টাকা পাবে, তাতে কোনো সুদ নেই।
গ্রামীণফোনের সিইও মাইকেল ফোলি বলেন, ন্যায্যতার সঙ্গে সমস্যা সমাধানে আমরা একমত হয়েছি। আশা করছি, এটা নিয়ে আর কোনো জটিলতা হবে না।
অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আমরা কয়েক দিন থেকেই আলাপ-আলোচনা করছিলাম। তাদের সঙ্গে আমাদের একটা সমাধানে আসা উচিত। সমাধানটি একটি উইন-উইন সিচুয়েশন থেকে হবে। আমরাও হারব না, তারাও হারবে না।
তিনি বলেন, আমাদের ন্যায্য দাবি যতটুকু হবে, ততটুকু আমরা আদায় করার চেষ্টা করব। তারাও সেটা মেনে নেবে- আমরা এটা বিশ্বাস করি। সে জন্য আমাদের এখানে বসা।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে যে বিরোধ চলছে, সে পথ থেকে বের হয়ে সমাধানের দিকে যাওয়া। সেটা আমরা করেছি। তারাও জিতবে। আমরাও (সরকার) জিতব। কেউ হারবে না।
কীভাবে সমাধান হবে প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, এখন কিছু বলা যাবে না। যখন সময় হবে, তখন বলব। তিনি মনে করেন, তারা (মোবাইল অপারেটর) ব্যবসা করবে, সরকারের পাওনা বুঝিয়ে দেবে। আমরা তাদের সাহায্য করব। যেটুকু সাহায্য করা দরকার, সেই পরিমাণ সাহায্য পূর্ণাঙ্গভাবে করা হবে। এটা হচ্ছে আমাদের উদ্দেশ্য।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, কিছু ভুল বোঝাবুঝির কারণে দুই অপারেটরের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে যাচ্ছিল। এ অবস্থা চলমান থাকলে আমাদের ক্ষতি হতো, আমরা রাজস্ব হারাতাম। তারা ব্যবসা করবে, আমরা নিজেদের পাওনা বুঝে নেব। তারা (দুই অপারেটর) যে মামলা করেছে, সে মামলা তারা প্রত্যাহার করে নেবে। অন্যদিকে সরকারের তরফ থেকে যে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করা হবে। অর্থমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে আমরা যে সিদ্ধান্ত নেব, তা কখনোই দেশের স্বার্থের বিপক্ষে যাবে না।