একবিংশ শতকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা ২০০৪ সালে ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা। সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রধান দুই দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মধ্যে অবিশ্বাস, দ্বন্দ্ব অনেক কিছু প্রেক্ষাপট হিসেবে উঠে আসছে ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা’।
২০০৪ সালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে এ হামলায় ২৪ জন নিহত ও তিন শতাধিক মানুষ আহত হন।
এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও তখন সরকারি হাসপাতালের নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আহতদের চিকিৎসার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন ডা. রোকেয়া সুলতানা। তিনি একজন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট, তখন জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। একইসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক।
আলাপকালে সেদিনের স্মৃতিচারণায় তুলে ধরলেন সে ভয়াবহ হামলা ও হামলা পরবর্তী চিকিৎসা সেবার কথা।
বঙ্গবন্ধু এভিনিউর চিত্র বর্ণনা করে ডা. রোকেয়া সুলতানা বলেন, আমি বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ছিলাম। নেত্রীর ভাষণের পর শুনলাম গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ। আর ধোয়া। আর কিছু দেখলাম না। ট্রাকের ওপর ধোয়া। আমি পরে গেলাম। আমি আস্তে আস্তে একটু ওঠার চেষ্টা করলাম। কয়েকজনকে ডিঙালাম। উদ্দেশ্য ছিল ট্রাকের কাছে যাওয়া। নেত্রীর হলোটা কি? কাউকে দেখলাম না। আমি বসে পড়লাম। দেখলাম একটা ভ্যান। ব্যানারে করে নিয়ে একজনকে তুললো। আরও কয়েকজনকে তোলা হলো। আল্লাহ! আমি চিন্তা করলাম এদেরকে নিয়ে যাচ্ছে কোথায়! বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে, ডাক্তার হিসেবে পালসটা দেখা দরকার। কিন্তু আগাতে পারলাম না।
তিনি আরও বলেন, এর মধ্যে ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ভাই বললেন, ঢাকা মেডিকেলে যাচ্ছি, তোমরা চলে আসো। আমি পীর ইয়ামেনী মার্কেটের সামনে গেলাম, পুলিশের লাঠি চার্জ। আমি পড়ে গেলাম। ওই রকমই আবার ওঠে দৌড় দিলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে হাইকোর্ট পাড় হলাম। একজন ভদ্রলোককে দেখলাম রিকশা দিয়ে যাচ্ছেন, ওনার রিকশাতে ঢাকা মেডিকেলে গেলাম।
ঢাকা মেডিকেল কলেজে পৌঁছে এক লোমহর্ষক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, সেখানে গিয়ে দেখি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। উনি ভাবি বললেন, না চাচি বললেন মনে নাই। বললেন, আইভি রহমানকে রেখে আসছি টেবিলের ওপরে, গিয়ে দেখো কি করা লাগবে। আমি গিয়ে দেখি, ওনার হাটুর ওপর থেকেই নাই। পালস খুবই কম। আমি হাতেই পালসটা দেখলাম। জিজ্ঞেস করলেন, আপা কেমন আছে? আমি বললাম, সবাই ভালো আছে। ওনার তো পা নাই। গালে স্পট। আমি ওনাকে টেবিলে রেখে স্যালাইন করছিলাম। ওষুধ-পাতি নাই, কোনো ডাক্তার নাই।
তিনি বলেন, জালাল ভাই বললেন, কোনো ডাক্তার নাই। যা করতে হবে আমাদের করতে হবে। কি লাগবে বলো। আমি বললাম, স্যালাইন এনে দেন।
ডা. রোকেয়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আইভি রহমানের সঙ্গে শেষ কথাগুলোর স্মৃতিচারণ করেছেন।
ডা. রোকেয়া বলেন, হাসপাতালে স্ট্রেচারে শুয়ে গ্রেনেডবিদ্ধ আইভি আপা মৃদু স্বরে নেত্রীর খোঁজ নিয়ে বললেন, শেখ হাসিনা কেমন আছে?’, তখন জালাল ভাই বললেন, ভালো আছে। আইভী আপা আশ্বস্ত হলেন।
কিন্তু আইভি রহমানের চিকিৎসা দিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের কোনো ডাক্তার পাওয়া যায়নি, পাওয়া যায়নি কোনো সিসিইউ কেবিনও। ডা. রোকেয়া বলেন, হাসপাতালে কাউকে পাচ্ছি না। ছাত্রলীগ করত, এমন একজন ডাক্তার ছিল। সে এসে বললো, আপা, আমি ছাত্রলীগ করি। কেউ জানে না। কি করতে পারি বলেন। আমি বললাম, স্যালাইন এনে দাও। আমি স্যালাইন আগে দেই।
হাসপাতালের বর্ণনা দিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের এই চিকিৎসক বলেন, এর মধ্যে দেখি, একেকজনের একে মাথা, ওখানে পা। এখানে মাথা। এমন অনেক আসা শুরু করলো। আমি বললাম, আমাকে স্যালাইন দেন, অ্যান্টিবায়োটিক দেন, গজ তুলা, অক্সিজেন এগুলো লাগবে। ডাক্তার-নার্স লাগবে।
সেই চিকিৎসকের সেদিন পরিচয় নেওয়ারও সুযোগ পাননি, পরবর্তীতে তার খোঁজ করলেও পাননি ডা. রোকেয়া। ডা. রোকেয়া বলেন, ওর নামও জিজ্ঞেস করেনি, জানিও না। ও চার-পাঁচটা স্যালাইন, ক্যানোলা এনে দিল। আমি ওই ছেলেকে খুঁজি। কিন্তু কেউ এসে পরে কখনো বললও না, আপা আমি ছিলাম।
ঢাকা মেডিকেলে সেদিন ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয় কারোই দেখা মেলেনি। ছিল না-ওষুধ, স্যালাইন, ব্যান্ডেজ, অক্সিজেন এমনকি স্যালাইন স্ট্যান্ড।
ডা. রোকেয়া সুলতানার মতে, সেদিন আওয়ামী লীগের হতাহতের সহায় ছিল দলীয় নেতাকর্মীরাই। তিনি বলেন, স্যালাইন স্ট্যান্ড নাই। আমাদেরই লোকজন স্যালাইন হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
‘আমি ওই ডাক্তারকে (ছাত্রলীগ করা চিকিৎসক) বললাম, প্রাণ রক্ষার্থে যে ওষুধগুলো, ইনজেকশন নিয়ে আসো। আমি টাকা বের করে দিলাম। কাকে পাঠালো, জানি না। কিছুক্ষণ পর এসে বললেন, দোকান সব বন্ধ। কাউকে দোকান খুলতে দেয়নি। আমি রেগে গেলাম। বললাম, আমি কি টাকা ফেরত চাইছি? মিটফোর্ড যাও।
এরমধ্যে ওনাদের ডাক্তার আসেনি কেউ। ডিরেক্টর আসছে, সিভিল ড্রেসে। আমি ওনার জামা ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, আমাকে স্যালাইন দেন, অক্সিজেন দেন, ব্লাড দেন।
তিনি বলেন, আমি মাঝে মধ্যে কয়েকজনকে ঘুমের ইনজেকশন দিচ্ছি। পালস দেখছি, ঘুম পারাচ্ছি। ‘
আক্ষেপ প্রকাশ করে এই চিকিৎসক বলেন, সেদিন যদি আমি ওষুধ পেতাম, ইনজেকশন, অক্সিজেন পেতাম তাহলে কিছু মানুষকে বাঁচাতে পারতাম, ভালো রাখতে পারতাম।
এসময় আইভি রহমানের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। ডা. রোকেয়া বলেন, আমি জালাল ভাইকে বললাম, ওনাকে (আইভি রহমান) কোথাও পাঠান বা সার্জন আনান। জালাল ভাই একজন সার্জন ম্যানেজ করলেন। আমি আইসিইউতে চলে গেলাম, সেখানে একজন ডাক্তার ছিল। তাকে আমি ডাকলাম, ওই মেয়ে এসে এনেস্থিসিয়া দিল।
আইভি রহমানকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিতেও নানা বেগ পেতে হয়েছে জানিয়ে রোকেয়া সুলতানা বলেন, মাঝ রাতের দিকে আমি আইভি আপাকে দেখছি, পালসের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আইসিইউ দরকার। আইসিইউ পেলাম না। পরে একটা অ্যাম্বুলেন্সে তাকে নিয়ে গেলাম ঠিক জাহাঙ্গীর গেটের ওখানে। সেখানে ঢুকতে দেয় না। আধা ঘণ্টা। পরে একজন ঢুলতে দিল। চলে গেলাম সিএমএইচে। আমি সেখানকার আইসিইউটা চিনি। আইসিইউর সামনে ট্রলি। তখন আবার ঢুকতে দেয় না। আমার সঙ্গে ডা. দেবব্রত বণিক ছিল। আমি বললাম, তুই পালস মেনটেইন কর।
আমরা মাত্র একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে গেছি, যদি ঢুকতে না দেয়, তখন আমি কি করব! পরে ঢুকলাম। সেখানে সব ঠিক করে ওই অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা মেডিকেলে আসলাম।
ঢাকা মেডিকেলে ফিরে আবার আহতদের সেবায় মনোনিবেশ করেন রোকেয়া। আমি বারবার তাদের মুখ দেখলাম, হাত দেখলাম, পালস দেখলাম। অনেকবার করে। আমার আর কিছু করার ছিলো না। একজন ডাক্তার হিসেবে যত জায়গায় পালস দেখা যায়, দেখেছি যে বেঁচে আছে কিনা। একজন বললো, আপা বারান্দায় মাহবুব ভাইর পিঠটা ঝাঁঝরা হয়ে আছে।
মাথার কাপড় তুলি আর খারাপ লাগে। কি নিসংসভাবে মৃত্যু! কি অপরাধ তাদের? আমি তাদেরকে দেখে- কার যে বাবা, কার যে মা! এখানে পরে আছে। তাদের দোষটা যে কি! সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মিটিং মিছিল করার কারণে এতগুলো মানুষের প্রাণ গেল!।
ঢাকা মেডিকেল কর্তৃপক্ষের সে সময়ের কার্যক্রম তুলে ধরে তিনি বলেন, কিছু নার্স এসেছিল। আমি অক্সিজেন চাইলাম। আমাকে খালি সিলিন্ডার এনে দিল। আমি বললাম, এতে অক্সিজেন নাই।
তিনি বলেন, ইমার্জেন্সিতে অনডিউটি ডাক্তার সব সময় থাকবে। ওয়ার্ডে আপনি ডাক্তার না পেতে পারেন। কিন্তু ইমার্জেন্সিতে ডাক্তার থাকবে। ইমার্জেন্সিতে যখন থাকে না! এটা তো পরিকল্পিতভাবে তারা করেছে যে, ওখানে এটা ঘটবে। এখানে তোমরা কেউ থাকবে না।
এরমধ্যে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার খোঁজ নেওয়ার সাহস পাননি বলে জানান ডা. রোকেয়া। বলেন, আমাদের নেত্রী কেমন আছে? আমি খবরও পাচ্ছি না। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও পারছি না। জালাল ভাইকেও জিজ্ঞেস করতে পারছি না। যদি খারাপ খবর পাই!।
২২ আগস্টের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা পরেরদিন আবার এসেছি রোগিদের দেখতে, কিন্তু ওখানে ওদের কোনো অনুভূতি নেই। একটা মানুষ যে আহত হয়ে এলো, কোনো অনুভূতিই নাই তাদের। ডাক্তার কেন, একটা নার্স, ওয়ার্ড বয় তাদেরও পাইনি।
প্রসঙ্গত, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় আহত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বীকৃতিও পেয়েছেন ডা. রোকেয়া। একাধিক সমাবেশে তিনি বলেছেন, আমাদের ডা. রোকেয়া অক্লান্ত চেষ্টা করেছে সেদিন।
এই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পরবর্তীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক মনোনীত হয়েছেন ডা. রোকেয়া সুলতানা।