‘চলমান সংকটে সরকারের আত্মবিশ্লেষণ প্রয়োজন’

image-832418-1722442823

দেশের চলমান সংকটে সরকারের আত্মবিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে বলে মন্তব্য করেছেন সম্মিলিত নাগরিক সমাজের সভাপতি ও অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ।

বুধবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে ‘বাংলাদেশে বিরাজমান সংকট : উত্তরণ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।

ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ বলেন, সরকারকে আত্ম-বিশ্লেষণ করে ঠিক করতে হবে যে, কী কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হলো। সরকারের কোনো কথায় ভুল ছিল কি না। সেটা নিয়ে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন আছে। আর কোনো অবস্থায় এই প্রক্রিয়া প্রশাসনের বলপ্রয়োগের ভিত্তিতে হলে হবে না। কারণ, বলপ্রয়োগের প্রক্রিয়া জাতিকে এক করতে পারে না। এখানে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কোনো সুষ্ঠু সমাধান হবে না।

তিনি বলেন, স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষ আছে, যাদের সংকটের সময় পাওয়া যায় না। যা আমরা এখন দেখছি। ছাত্রসমাজ যৌক্তিক দাবির জন্য যে আন্দোলন করছিল, তা তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় বহু প্রাণহানি হয়েছে। যারা নিহত হয়েছে তাদের পরিবারের প্রতি আমাদের সমবেদনা থাকবে।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, দেশের ক্ষয়ক্ষতি যে পরিমাণ হয়েছে, তাতে এটি উত্তরণ করতে অনেক সময় লাগবে। দেশে বর্তমানে বহু সংকট চলছে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক সংকট, সামাজিক সংকট এবং রাজনৈতিক সংকট আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনায় সংকট আমাদের এখানে আছে। আমাদের এখানে প্রশাসন যেভাবে কাজ করার কথা, সেভাবে হচ্ছে না। যখন কাউকে কাস্টডিতে নিয়ে কোনো বক্তব্য নেওয়া হয়, তখন স্বাভাবিকভাবে সেটা গ্রহণযোগ্য হয় না। কিন্তু তারপরও সেটা করা হয়। এগুলো তামাশা বাদে আর কিছু না।

তিনি বলেন, এরপর আছে দর্শনগত সংকট। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসহ আমাদের যে চারটি স্তম্ভ আছে- সেগুলো এখন সংকটে আছে। যে ঘটনা বাংলাদেশে হয়েছে, সেটা হচ্ছে আক্রমণ বাংলাদেশ, আক্রমণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা আছে, আমাদের গণতন্ত্রের চেতনা আছে, সমাজতান্ত্রিক চেতনা আছে। মোটকথা আমরা দর্শনগত সংকটে আছি।

ড. কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমরা সাধারণের সহযাত্রী হতে পারছি না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আমাদের সবাইকে সহযাত্রী হতে হবে। আমাদের সঠিক তথ্য প্রবাহের সংকট আছে। মানুষের কাছে এত বেশি ভুল তথ্য যাচ্ছে, যার কারণে এর মধ্য থেকে আমরা সঠিক তথ্য পাচ্ছি না।

তিনি বলেন, আরেকটি হচ্ছে অস্তিত্বের সংকট। আমরা যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়েছিলাম, সেটি এখন সংকটে আছে। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে সার্বিকভাবে আস্থা তৈরি করতে হবে। আর এটা করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাস করে, তাদের সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আর সেখানে নেতৃত্ব দিতে হবে শেখ হাসিনাকে। সবাইকে একসঙ্গে নেওয়ার যে ব্যবস্থা, সেটা তাকে করতে হবে। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লোকজন যদি বিচ্ছিন্নভাবে থেকে যায়, তাহলে একা চেষ্টা করে সেটাকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। কাজেই এই প্রক্রিয়াটি হতে হবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। যা হবে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, গত জুলাই মাসের শুরু থেকে দেশের যে অবস্থা দেখছি, তাতে অবস্থা ভালো থাকার কথা না। এখন বাংলাদেশে এক প্রকার দূরবস্থা চলছে। যার ফলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর কারণ দেশ চালানো নীতির সমস্যার কারণে। আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীদের কিন্তু গত ১৫ দিন ধরে দেখা যাচ্ছে না। যারা সুবিধার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশেপাশে ঘুরেন তাদেরও কিন্তু দেখা পাবেন না। তাদের আলোচনা বা টকশোর জন্য ডাকলে এখন তারা আসে না, ফোন করলে বলে ব্যস্ত আছেন।

তিনি বলেন, হঠাৎ করে সরকার সিদ্ধান্ত নিল জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করবে। তাহলে কি জামায়াতের অর্থনীতি নিষিদ্ধ হবে? জামায়াতের ৮১টি প্রতিষ্ঠান যেগুলো দিনের পর দিন ব্যবসা করে আসছে, সেগুলো কি বন্ধ হবে?

বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক মহাপরিচালক ম. হামিদ বলেন, আজকে যে অর্থনৈতিক সংকট, সামাজিক সংকট, রাজনৈতিক সংকট; তারচেয়েও বড় যেটা অস্তিত্বের সংকটের কথা উঠেছে। এ বিষয়ে বেশি করে ভাবতে হবে এবং আগামীতে এটা নিয়ে আমাদের কাজও করতে হবে। আমরা নিজেদের আত্মতুষ্টি নিয়ে অনেকদিন কাটিয়েছি। আমাদের রাজনৈতিক সক্ষমতা-দক্ষতা নিয়ে আমরা যতটা ভেবেছি যে, আমরা অনেক কিছু অর্জন করেছি। সেটা যে কতটা মেকি ছিল, ঠুনকো ছিল, সেটা ছোট ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণ পেয়ে গেল। বিটিভিতে কয়েক দফায় হামলা ও লুট হয়েছে। অর্থাৎ একটা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার বিষয়ে পেশাদারিত্বের অভাব রয়েছে এবং সেগুলোর চারপাশে যে ধরনের সুযোগ থাকা দরকার সেখানেও পেশাদারিত্বের অভাব রয়েছে। এই জায়গাগুলো আমাদের ভাবতে হবে।

বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ-উপাচার্য রশিদ ই মাহবুব বলেন, স্বৈরশাসক গেলেও তাদের প্রেতাত্মারা রয়েছে। যখনই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকে, তখন তাদের বিপদে ফেলার চেষ্টা হয়। সরকারকে ব্যর্থতার দায় নিতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করতে পারছে না সরকার। সরকারের কোনো নীতি নিয়ে নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা হয় না। সমাজের সব স্তরে এক ধরনের লোভী ভাব দেখা যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। যারা চোর, লুটেরা তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি।

ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক শামসুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে এমন কিছু ঘটতে পারে সেটা সরকার কেন বুঝতে পারল না, তা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। এখন ছাত্রদের আন্দোলনে থাকার যৌক্তিকতা নেই। তারপরেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে কেউ কেউ আন্দোলন সংগঠিত করার চেষ্টা করছে।

Pin It