পরিবহন ও সরবরাহ প্রক্রিয়ায় চাঁদাবাজি বন্ধ হলে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়বে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট খাতের আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। এ জন্য ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যমন্ত্রীর সহযোগিতা চেয়েছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার। থানা, পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসনসহ উচ্চ পর্যায় থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রমজান উপলক্ষে আলাদা মনিটরিং সেল খুলবে।
বুধবার আসন্ন রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের স্থানীয় উৎপাদন, আমদানি, মজুদ ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য এক বৈঠক হয়। সেখানে ব্যবসায়ীরা বলেন, রমজানে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ চাঁদাবাজি। রমজান এলেই প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা, শ্রমিক সংগঠন, ব্যবসায়ী সমিতিসহ বিভিন্ন খাত থেকে ব্যবসায়ীদের কাছে নানান অজুহাতে চাঁদা চাওয়া হয়। বন্দর, গুদাম ও মিলে পণ্য প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় ব্যাপক চাঁদা দিতে হয়, যে কারণে মূল্য বেড়ে যায়। জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী চাঁদাবাজি বন্ধে সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে অবহিত করেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি পরিচালনা করেন বাণিজ্য সচিব মফিজুল ইসলাম। বৈঠকে চিনি, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, খেজুর, ছোলা ও ডালের আমদানিকারক, পরিশোধনকারী ও পাইকারি ব্যবসায়ী, পণ্য মূল্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
এফবিসিসিআই সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, সরকার পণ্যমূল্য ঠিক রাখতে চাইলে ব্যবসায়ীদের সমস্যা সমাধান করতে হবে। ব্যবসায়ীদের খরচ হলে তা পণ্যের ওপর চাপবেই। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, অযৌক্তিকভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়াবেন না। ক্রেতাদের অস্বস্তিতে ফেলবেন না।
সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান বলেন, বন্দর, গুদাম ও মিল গেটে প্রচুর চাঁদাবাজি হয়। চাঁদাবাজি বন্ধে থানার ওসিদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া দরকার। এছাড়া মিলগুলোর উৎপাদন ঠিক রাখার জন্য তিনি রমজানে গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ ভালো রাখার অনুরোধ করেন।
মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল বলেন, সব ধরনের পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। আবার আমদানির জন্যও যথেষ্ট এলসি খোলা হয়েছে। সরবরাহে কোনো ঘাটতি হবে না। ফলে পণ্যমূল্য বাড়ার কোনো কারণ নেই।
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এনায়েত হোসেন চৌধুরী বলেন, পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ চাঁদাবাজি। এটা বন্ধ করা গেলে দাম বাড়বে না। পাশাপাশি খুচরা বাজারে মনিটরিং বাড়ানোর সুপারিশ করেন তিনি।
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবিএম ফজলে রাব্বি বলেন, রমজান এলেই চাঁদাবাজি বেড়ে যায়। এছাড়া অনেক মিলেও হঠাৎ করেই সমস্যা তৈরি হয়। এতে পণ্য সরবরাহ কমে দাম বেড়ে যায়।
মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রবিউল আলম বলেন, গরুর ট্রাকে ঘাটে-পথে সবখানে ব্যাপকহারে চাঁদাবাজি হয়। যে কারণে মাংসের দাম বেড়ে যায়।
ব্যবসায়ীদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ডিআইজি রুহুল আমিন ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, চাঁদাবাজির ঘটনা কোথাও ঘটলে নিকটবর্তী থানায় জানাবেন। নতুবা পুলিশ সুপারকে জানাবেন। সবখানেই চাঁদাবাজি বন্ধে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া আছে। পাশাপাশি পুলিশ হেডকোয়ার্টারেও একটি বিশেষ সেল খোলা হবে।
সবার বক্তব্য শুনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, চাঁদাবাজির অভিযোগ অনেক দিন ধরেই আছে। রংপুরে একটা পণ্য ১০ টাকায় পাওয়া গেলে ঢাকায় তার দাম হয় ৪০ টাকা। ঢাকায় কেন দাম বেশি জানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, পরিবহন খরচ, পুলিশ, নেতা, শ্রমিক সংগঠন, ব্যবসায়ী সমিতির চাঁদার মতো একটা ব্যাপক ফিরিস্তি দেন। এ জন্য চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও এ বিষয়ে ইতিবাচক। যেকোনো মূল্যে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। থানা থেকে এসপি লেভেল বা তার ওপরে সেল করে দেওয়া হবে, যাতে কোনো জায়গা থেকে অভিযোগ করলে মোকাবেলা করা যায়।
পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা চেয়ে বলেন, সবাই বলেন বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ী। আমি নিজেও তাই মনে করি। এ জন্য ব্যবসায়ীদের কাছে অনুরোধ আপনাদের (ব্যবসায়ীদের) এই অনুভূতি থাকা দরকার যাতে বাণিজ্যমন্ত্রীর মুখে কালি না পড়ে। মন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ীরা বলছেন তাদের যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। ফলে সততার সঙ্গে কাজ করলে দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। মন্ত্রণালয়ও এজন্য মনিটর করবে।
বাণিজ্য সচিব মফিজুল ইসলাম বলেন, প্রতি বছরই রমজানের আগে ব্যবসায়ীদের নিয়ে সভা করা হয়। ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি দেন মূল্য বাড়বে না। তারপরও দেখা যায়, কোনো না কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এ বছর যাতে এরকম না হয়।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান জ্যোতির্ময় দত্ত, টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহাঙ্গীর, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর এবং এনবিআর, কৃষি মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন বাজার কমিটির নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।