বিভ্রাটের কবলে পড়ে যে ছয় ঘণ্টা ফেসবুক বন্ধ ছিল, ঐ সময়ে পুঁজিবাজারে কোম্পানিটির দরপতনে মার্ক জাকারবার্গের সম্পদের অর্থমূল্য কমে গেছে ৬০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যেটার পরিমাণ ৫১ হাজার কোটি টাকা। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের শীর্ষ এই সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানির শেয়ারের দরপতনের কারণে বিশ্বের ধনী ব্যক্তির তালিকাতেও এক ধাপ নিচে নেমে গেছেন জাকারবার্গ।
গত সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিভ্রাটের কবলে পড়ে ফেসবুক। কেবল ফেসবুক নয়, এ কোম্পানির মালিকানাধীন ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জারসহ অন্যান্য সেবাও বন্ধ হয়ে যায়। এই বিভ্রাটের জন্য নিজেদের ভুলের কথা স্বীকার করেছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। ফেসবুক নিজেই এক ব্লগে জানিয়েছে, তাদের ভুলে বিভ্রাট ঘটেছিল। তবে এটি কোনো নাশকতা কি না সে ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। এই বিভ্রান্তির মূল কারণ ছিল ত্রুটিপূর্ণ কনফিগারেশন পরিবর্তন। কোন কর্মী এটা করেছেন সেটাও তারা বলেননি। এদিকে ফেসবুকের বিরুদ্ধে বোমা ফাটিয়েছেন সাবেক কর্মী ফ্রান্সেস হাউগেন।
মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেলে এক সাক্ষাত্কারে তিনি অভিযোগ করেন, অনলাইনে ভুয়া তথ্যের প্রচারণা, মিথ্যাচার, সহিংসতা বন্ধে বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের দাবি করে আসছে ফেসবুক। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব গবেষণা বলছে একদমই উলটো কথা। সমাজব্যবস্থার ওপর প্ল্যাটফরমটির বিরূপ প্রভাবের প্রমাণ উঠে এসেছে একাধিক সূত্র থেকে। এ প্রসঙ্গে হাউগেন বলেন, আমরা এমন একটি তথ্যনির্ভর পারিপার্শিক অবস্থার মধ্যে আছি যেটা ক্ষোভ, বিদ্বেষ এবং মেরুকরণের কন্টেন্ট দিয়ে পূর্ণ, এটা আপনার নাগরিক বিশ্বাসকে ক্ষয় করতে থাকে, একে অন্যের ওপর বিশ্বাস নষ্ট করতে থাকে, আমাদের একে অন্যের যত্ন নেওয়ার ক্ষমতা কমাতে থাকে। ফেসবুকের যে সংস্করণটি এখন আছে সেটা আমাদের সমাজব্যবস্থাকে ছিড়ে ফেলছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতিগত সহিংসতার জন্ম দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন ফ্রান্সেস হাউগেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, জটিলতা কাটিয়ে ফেসবুকের সেবা চালু করতে লেগে যায় প্রায় ছয় ঘণ্টা। এই সময়ে পুঁজিবাজারে ফেসবুক ইনকরপোরেশনের শেয়ারের দাম ৪ দশমিক ৯ শতাংশ কমে যায়। গত নভেম্বরের পর এক দিনে ফেসবুকের শেয়ারের দরপতনের সবচেয়ে বড় ঘটনা এটি। এই দরপতনের কারণে জাকারবার্গের সম্পদের অর্থমূল্য কমে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ১৬০ কোটি ডলারে। ফলে ব্লুমবার্গের বিলিয়নেয়ার ইনডেক্সে এক ধাপ নিচে নেমে জাকারবার্গের অবস্থান এখন বিল গেটসের পর পাঁচ নম্বরে। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় ১৪ হাজার কোটি ডলার থেকে কমে জাকারবার্গের সম্পদের পরিমাণ বর্তমান অবস্থানে নেমেছে।
ফেসবুক কর্তৃপক্ষ নিজেদের এক পোস্টে জানিয়েছে, রাউটারে কনফিগারেশন পরিবর্তন করতে গিয়ে ভুল করায় সবচেয়ে বড় বিভ্রাটের শিকার হয়েছে ফেসবুক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জন ফেসবুক কর্মী বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছে, শুরুতেই তারা ধারণা করেছিলেন, অভ্যন্তরীণ ভুলের কারণে এ বিভ্রাট ঘটেছে। কর্মীরা বলেন, ইন্টারনাল কমিউনিকেশন টুল এবং অন্যান্য বিষয়ের ব্যর্থতার কারণে ফেসবুকের ত্রুটি আরো বড় হয়ে উঠে। বিভ্রাটের শুরুতে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, কোনো কর্মীর অনিচ্ছাকৃত ভুল বা অভ্যন্তরীণ কোনো নাশকতা, যে কোনো কিছুই বিভ্রাটের কারণ হতে পারে। এবার ফেসবুক নিজেই এক ব্লগে জানাল, তাদের ভুলে বিভ্রাট ঘটেছিল। ওয়েব মনিটরিং গ্রুপ ডাউন ডিটেক্টর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ফেসবুকের এবারের বিভ্রাট এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড়। ফেসবুকের বিভ্রাটগুলো ব্যাপক এবং বিশ্ব জুড়ে বিস্তৃত ছিল। বিশ্ব জুড়ে সাড়ে ৩০০ কোটি ব্যবহারকারী ফেসবুকে প্রবেশ করতে পারেননি।
ফেসবুকের সাবেক কর্মী ফ্রান্সেস হাউগেন গতকাল মঙ্গলবারই মার্কিন সিনেটে সাক্ষ্য দিয়েছেন। ঠিক তার আগের দিন মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেলে এক সাক্ষাত্কার দেন তিনি। সাক্ষাত্কার জুড়েই ফেসবুকের নানা নেতিবাচক দিকে আলোকপাত করেছেন হাউগেন। প্রযুক্তি শিল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তার। তিনি বলেন, ফেসবুকে আমি যেটা বারবার দেখেছি সেটা হলো, জনসাধারণের জন্য কোনটা ভালো আর ফেসবুকের জন্য কোনটা ভালো, তার মধ্যের স্বার্থের দ্বন্দ্ব। আর ফেসবুক প্রতিবারই আরো বেশি মুনাফা অর্জনের মতো নিজের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার ধার ধারে না ফেসবুক। তিনি বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই প্রতিষ্ঠানটির। ফেসবুকের যে বিভাগে আমি কাজ করতাম, তার নাম ছিল ‘নাগরিক শুদ্ধতা (সিভিক ইন্টিগ্রিটি)। ফেসবুক যেন সমাজের জন্য একটি ইতিবাচক শক্তি হয়ে উঠে, সেটা নিশ্চিত করাই ছিল ঐ বিভাগটির দায়িত্ব। নির্বাচনের ঠিক পর পরই তারা এই বিভাগটি ভেঙে দেয়।