“তারা মুক্তিযুদ্ধেও আছে, ধর্মেও আছে। হ্যাঁ, তারা সংবিধানে থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়াতেও আছে, আবার ধর্মের সুযোগ নিয়ে জামায়াতকে একটা গালি দেওয়াতেও আছে। ফলে বিএনপির মূল রাজনৈতিক ভিত্তিটাই কিন্তু নড়বড়ে হয়ে আছে।”
চব্বিশের অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া বাস্তবতায় আগামী ফেব্রুয়ারিতে যে জাতীয় নির্বাচন হচ্ছে যাচ্ছে, সেই নির্বাচন কোন পথে নিয়ে যাবে ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশকে?
রাজনীতির বিশ্লেষক, সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মনে করেন, সামনে এখন ‘দুটো রাস্তা’ খোলা আছে।
“একটা হল যে ডানপন্থিদের সঙ্গে দেশের বাস্তবতা এবং দেশের অধিকাংশ মানুষকে একটা লড়াই, সংগ্রাম, বোঝাপড়া করে অস্থিরতার মধ্যে দেশ যাবে।
“আর এই নির্বাচন বা যত দ্রুত পারা যায় সকলের জন্য গণতান্ত্রিক রাজনীতির দুয়ার খুলে দিয়ে আওয়ামী লীগসহ দুয়ার খুলে দিয়ে দেশে গণতন্ত্র এবং পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসিটাকে স্থিতিশীল করার দিকে অগ্রসর হওয়া।”
বিএনপি নেতাকর্মীরা আশায় আছেন, আওয়ামী লীগবিহীন নির্বাচন তাদের সহজেই সরকারে নিয়ে যাবে। কিন্তু সংকট সামলাতে দক্ষতার পরিচয় দিতে না পারাসহ নানা সংকট বিএনপির মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন মোজাম্মেলন হোসেন।
এবং, তার ভাষায়, “তারেক রহমানের সংকট বড় অংশে তিনি নিজে তৈরি করেছেন।”
আবার অতীতে যারা ৪ থেকে ১২ শতাংশ ভোট পেয়েছে, সেই জামায়াতে ইসলামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে ভালো ফল দেখিয়ে দেবে, তেমনটাও মনে করতে পারছেন না মোজাম্মেল হোসেন।
তার ভাষ্য, জামায়াতে ইসলামী অত্যন্ত ‘সুসংগঠিত’ দল, সে কারণে তাদের ‘আওয়াজ’ বেশি।
তিনি মনে করেন, নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে ব্যবধান কমে এসে এমন একটা ফল হতে পারে যে দুটো দলকে সরকার গঠন করার জন্য বিভিন্ন ছোট দলের সাহায্য খুঁজতে হবে।
আলোচনা অনুষ্ঠান ইনসাইড আউটে যোগ দিয়ে নির্বাচনের পাশাপাশি খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, তারেক রহমানের ফেরা না ফেরা, বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যত, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের থাকা না থাকা, অন্তর্বর্তী সরকারের দেশ পরিচালনা, বন্দরের দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে দেওয়া নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।
‘তারেক রহমানের সংকট তিনি নিজেই’
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘সংকটময় পরিস্থিতিতে’ তার ছেলে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এক বক্তব্য ঘিরে দেশের রাজনীতিতে নতুন আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে, যার সুরাহা এখনো হয়নি।
নভেম্বরের শেষে এক ফেইসবুক পোস্টে তিনি বলেন, “এমন সঙ্কটকালে মায়ের স্নেহ স্পর্শ পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা যে কোনো সন্তানের মত আমারও রয়েছে। কিন্তু অন্য আর সকলের মত এটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমার একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।”
মোজাম্মেল হোসেন মনে করেন, জনগণের কাছে‘ স্বচ্ছ না থেকে’ তারেক রহমান নিজেই তার সংকট সৃষ্টি করেছেন।
“সেটা এই দিক থেকে যে তিনি ১৭ বছর দেশের বাইরে। কী পরিস্থিতিতে তিনি গিয়েছিলেন এবং এত দীর্ঘদিন আছেন আমরা তো জানি। কিন্তু তার সংকট তিনি এইভাবে তৈরি করেছেন যে তিনি নিজেকে অস্বচ্ছ রেখেছেন।
“জনগণের সাথে রাজনৈতিক নেতার সম্পর্ক হবে পারস্পরিক বিশ্বাস, পারস্পরিক আস্থা, ভালোবাসার। জনগণের কাছে নিজেকে লুকিয়ে নিজের চারপাশে একটা আবরণ সৃষ্টি করে কখনো রাজনৈতিক নেতা হওয়া যায় না।”
মোজাম্মেল হোসেন মনে করেন, তারেক রহমানের রাজনৈতিক নেতা ‘উজ্জ্বল সম্ভাবনা’ একসময় মানুষ দেখেছিলে এবং বিএনপি নির্বাচনের জিতলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন বলেও কর্মী-সমর্থকরাও মনে করতেন।
তারেক রহমান কোন ‘স্ট্যাটাসে’ লন্ডনে অবস্থান করছে তা জনগণ জানতে চায় মন্তব্য করে মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “তিনি আসছেন না কেন? মায়ের ঘোরতর অসুস্থতার সময় তিনি যে শুধু এলেন না তা নয়, তখন একটা কথা বললেন যে আমি তো মায়ের কাছে ছুটে যেতে চাই কিন্তু এই সিদ্ধান্ত আমার একার উপর নির্ভর করে না।
“এবং তার বাধাটা কোথায় সেটা তিনি খুলে বলতে পারছেন না। আমি এই জায়গাটাতেই বলছি যে জনগণের কাছে নিজেকে অস্বচ্ছ রেখে তার সংকট কী, এই প্রশ্নের জবাব আমরা দেব তা বলা যায় না। বহুলাংশে তাকেই দিতে হবে এই প্রশ্নের উত্তর। আর তার এই অবস্থার জন্য বিএনপি এবং দেশের রাজনীতিতে নিশ্চয় অনেক গভীর রেখাপাত করছে।”
সরকারের রাজনৈতিক কৌশল?
গুরুতর অসুস্থ খালেদা জিয়াকে কেন ভিভিআইপি ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির সমমর্যাদার নিরাপত্তা ব্যাবস্থা দেওয়া হল, সেই প্রশ্নে অন্য এক সম্ভাবনার কথা বললেন মোজাম্মেল হোসেন।
তার মতে, “আমার মনে হয় যে লক্ষ্যটা খালেদা জিয়া না। আমার মনে হয় লক্ষ্যটা তারেক। সেটি হচ্ছে, তারেককে নিয়ে বর্তমান সরকারেরও অনেক অস্বচ্ছ রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা, কৌশল ইত্যাদি আছে। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা লন্ডন পর্যন্ত গিয়েছিলেন তারেকের সঙ্গে কথা বলতে। এবং তাকে অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদা দিয়ে তারা একই সঙ্গে প্রেস ব্রিফিং করে বলেছিলেন যে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হবে। তারপরে বিএনপি ভাবছিল যে তাদের জন্য একটা অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হল নির্বাচনে যাওয়ার জন্য।
“কিন্তু তারপরে আমরা অনেক কিছু দেখলাম। আর এই সময় বলছি যে এই ভিভিআইপি মর্যাদা দেওয়া এবং উচ্চ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা খালেদা জিয়ার চেয়ে বেশি লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে তারেক। তা হচ্ছে তারেকের যাতায়াতটা একটু সীমিত করে ফেলা।”
খালেদা জিয়ার হাসপাতালের পাশে হেলিকপ্টারে মহড়া নিয়েও জনগণের মনে ‘অস্পষ্টতা’ আছে বলে মরেন এ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।
তার ভাষ্য, “বললেই হয় যে খালেদা জিয়া এত গুরুতর অসুস্থ যে হসপিটাল থেকে বাই রোড না নিয়ে তাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া হবে হেলিকপ্টারে। কিন্তু হেলিকপ্টার মহড়া দিয়ে এটা কী কাজে লাগবে বলা হল না।
“এমনও হতে পারে যে কোনো অবস্থায় তারেক জিয়া যদি আসেন, তাহলে এয়ারপোর্ট থেকে তাকেই নিয়ে আসা হবে এই জায়গায়, এই জন্যই হেলিকপ্টার ওঠানামার মহড়া।”
মোজাম্মেলন হোসেন বলেন, “আমরা জানি না এটি নিশ্চিত কিনা, সরকারও এটা খুলে বলছেন না। এটি যদি হয়, তাহলে আমরা অনুমান করব যে তারেক জিয়াকেও রেস্ট্রিক্টেড করা একটা লক্ষ্য, অন্তত কয়েকদিনের জন্য বা কিছু সময়ের জন্য।”
দেশের মানুষ ৮০ বছর বয়সী রাজনীতিবিদ খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের শান্তি প্রত্যাশা করে মন্তব্য করে এই বিশ্লেষক বলেন, “কিন্তু রাজনীতি সেটা হতে দিচ্ছে না। রাজনীতি এই জটিলতাগুলো তৈরি করেছে।”
খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে নানা গুজব বিএনপি আরো ভালোভাবে সামল দিতে পারত কি না, সেই প্রশ্ন রাখা হয়েছিল মোজাম্মেল হোসেনের সামনে। জবাব দিতে গিয়ে তিনি ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাতে বলেন।
“বিএনপি এখন নানা রকম সংকটে আছে। তাদের চেয়ারপারসন গুরুতর অসুস্থ। তাদের যিনি প্রধান নেতা, এখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন, তিনি আসতে পারছেন কি পারছেন না এই নিয়ে বিএনপির নেতৃত্বের দিকটা তারা যে সংকটে আছে, সেটা আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু আমরা দেখব যে বিএনপির গত ৪০ বছরের ইতিহাসে তারা কিন্তু খুব জটিল পরিস্থিতি ভালোভাবে সামাল দিতে পারেনি তাদের রাজনীতির ক্ষেত্রেও।”
এ প্রসঙ্গে ১৯৯৪ সালের মাগুরার উপনির্বাচন, মিরপুরের নির্বাচন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের কাছে ‘নতি স্বীকার’, পরেরবার ক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ‘নিজেদের লোক বসাতে’ বিচারপতিদের বয়স নিয়ে আইন পরিবর্তনের উদাহারণ টানেন এ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।
বিএনপি দল হিসাবে ‘খুব ভালো ক্রাইসিস ম্যানেজার না’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তাদের চেয়ারপারসনের এই দুঃসময়েও তারা এই পারফরম্যান্সটা খুব ভালো দেখালেন না। কারণ এই রাজনৈতিক পরিবর্তন, যেটা গত (২০২৪ সালের) জুলাই-অগাস্টে হল, তারপর থেকে বিএনপির একমুখী চিন্তা, যে নির্বাচনটা দ্রুত হলে আমরা ক্ষমতায় চলে যেতে পারি। কিন্তু নির্বাচনটা দ্রুত হওয়ার পথে যে কোনো বাধা থাকতে পারে, সেইগুলোর বিষয়ে যে ভালো কৌশল গ্রহণ করতে হতে পারে, নিজেদের নেতৃত্ব শক্ত রাখতে হতে পারে, এগুলো কোনোটা কিন্তু তারা ভাবেনি।
“তাদেরকে একরকম টেনেটুনে নিয়ে গেল আপনার এই যে ঐকমত্য কমিশন। তারা অতটা রাজি না অসাংবিধানিক পথে যেতে বা সংবিধানে বড় বড় পরিবর্তন করতে। তারা গণভোটে রাজি না, আবার গণভোটে রাজি হয়ে গেলেন। এই সময়টাতেই কিন্তু আমরা দেখছি যে তারা সংকট সমাধান করতে ভালো না।”
‘নির্বাচন প্রভাবিত হওয়া উচিত নয়”
নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষের মনে ‘গভীর সংশয়’ আছে বলে মনে করলেও খালেদা জিয়ার অসুস্থতা বা তারেকের না আসায় ‘নির্বাচন প্রবাহিত হওয়া উচিত নয়’ বলে মনে করেন মোজাম্মেল হোসেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নির্বাচন নিয়ে সংশয় আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা বা তার পুত্র বিএনপির মূল নেতা তারেক রহমানের আসতে পারা না পারা এর উপরে আমাদের জাতীয় নির্বাচন খুব বেশি নির্ভর করা উচিত তা আমি মনে করি না এবং কোনো যুক্তি নাই। সেটি হল যে মানুষ মরণশীল। বয়স হয়েছে, অধিকন্তু অসুস্থ। তো তার জীবনাবসান ঘটতে পারে। তার জীবনাবসানের সঙ্গে এটির কোনো সম্পর্ক নেই।”
তারেক রহমানের ‘আসা-না আসা’ তার নিজের ও বিএনপির ওপর নির্ভর করে এবং এর প্রভাব তিনি ও তার দলকেই ভোগ করতে হবে মন্তব্য করে এ বিশ্লেষক বলেন, “জাতীয় নির্বাচনের উপরে তার আসা না আসা এটি বড় আকারে নির্ভর করার কোনো যুক্তি নাই।”
নির্বাচন না হলে কী হবে
বিএনপি নেতারা বলে আসছিলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে ‘সর্বনাশ’ হবে। তাদের ওই আশঙ্কায় ভুল কিছু দেখছেন না মোজাম্মেলন হোসেন।
তিনি বলেন, “নির্বাচন না হলে দেশের সংকট আরো তীব্রতর হবে। সেটি হচ্ছে অস্থিরতা বাড়বে।”
দেশ পরিচালনা, নির্বাচন আয়োজন, ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারকে অনেকটা সুযোগ দিলেও সরকার নিজে উদ্যোগী হয়ে অনেক কাজে হাত দিয়েছে বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক।
তিনি বলেন, “তারা নিজেরা নানা রকম জটিল কাজ তাদের হাতে নিল সংস্কারের নামে। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে কিছু বন্দর ইজারা দেওয়া বা করিডোর– ইত্যাদি তারা সেধে সেধে এই সমস্যাগুলো আনলেন।”
এদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে যে জনমনে শঙ্কা আছে, সে কথা তুলে ধরে মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘মবের ভয়ে’ সামাজিক মর্যাদাবান নাগরিকরা নিরাপদ অনুভব করছেন না।
দেশের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্ব ব্যাংক ইতোমধ্যে সতর্ক করেছে, সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “প্রায়ই বলা হয় যে আমাদের রিজার্ভ ভালো আছে। রিজার্ভ না, আপনার মোট জাতীয় উৎপাদন, মানুষের কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য সুচারুভাবে চলা–এই সবগুলো সূচকে আমাদের অবস্থা খারাপ।”
একাধিক পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “আপনি বলছেন যে নির্বাচন যদি ফেব্রুয়ারিতে না হয়, তো ফেব্রুয়ারিতে না হলে ঈদের পরে, ঈদের পরে মানে কোরবানির ঈদের পরে, কেমন? কমপক্ষে ছয়-সাত মাসের ধাক্কা, তারপরে নতুন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় কিনা। এই যে অনিশ্চয়তা, এই অনিশ্চয়তার মধ্যে আমাদের দেশের প্রভূত ক্ষতি হবে। সেই মূল ক্ষতি হল দেশে একটা বিশৃঙ্খলা এবং অস্থিরতা সৃষ্টি হবে, মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়বে। এটি কোনোভাবেই আমাদের কাম্য নয়।”
খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ঘিরে বিএনপি নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে ‘কিছুটা ছিটকে গেলেও’ ৩৬ আসনে তাদের প্রার্থী ঘোষণার মধ্যে ‘নতুন করে মাঠে ফেরার চেষ্টা’ দেখছেন এ সাংবাদিক।
অথচ এই সময়ে জামায়াতে ইসলামী যে জোরেশোরে নির্বাচনী কার্যক্রম চালিয়ে গেছে, সে বিষয়টি তুরে ধরে তিনি বলেন, “তারা বিভাগীয় সভাগুলো করেছে। এবং তাদের বক্তৃতার ভাষাও এমন করে বদলে যাচ্ছিল। ‘আমরা সূর্যকে থামিয়ে দিতে পারি’। ‘ওসি সাহেবকে সকালে এসে আমাদের কাছে হাজিরা দিয়ে কাজ শুরু করতে হবে’। অডাসিটি এটা কিরকম! তারা ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই এই ভাষা।
“তো এই সময়ে তারা মনে করেছে যে বিএনপি গর্তে পড়েছে, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি খুব জোরেশোরে।”
জামায়াতের স্বপ্ন পূরণ হবে
সাম্প্রতিক জনসভাগুলোতে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের কথায় আত্মবিশ্বাসের সুর স্পষ্ট। জুলাই অভ্যুত্থানে দলের নেতাকর্মীদের ভূমিকার কথা খোলামেলাভাবেই তারা বলছেন। চার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদের নির্বাচনে বড় জয়ের পর জাতীয় নির্বাচনেও তারা একটি ফল পাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।
তবে জাতীয় নির্বাচনে জনগণের ভোটে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনে জিতে যাওয়া বা সরকার গঠন করা ‘কষ্টকল্পনা’ বলে মনে করছেন মোজাম্মেল হোসেন।
তিনি বলেন, “এতটা হয়ত ভাবা যায় না এই জন্য যে তারা জীবনে কোনোদিন নির্বাচনে জেতে নাই। তারা প্রতিটি নির্বাচনে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। ৪ শতাংশ, ৫ শতাংশ, ১২ শতাংশ পর্যন্ত হয়তো ম্যাক্সিমাম তারা ভোট পেয়েছে।”
বর্তমান সময়ে জামায়াতে ইসলামী কার্যকালাপ নিয়ে নিজের ধারণা তুলে ধরে এই বিশ্লেষক বলেন, “আমার বাস্তবভিত্তিক ধারণা হচ্ছে যে জামায়াতের হাইপ বেশি, মানে আওয়াজ বেশি। কেন আওয়াজ বেশি জানেন? ওরা অত্যন্ত সুগঠিত দেশ, সুসংগঠিত দল। এবং তাদের ক্যাডাররা এবং সমর্থকরা এত অনুগত যে তারা একটা কর্মসূচি দিলে আমি বলব যে একেবারে কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ ৮০ শতাংশ লোক হাজির হয়।”
জামায়াতে ইসলামীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা ‘কম দেখলেও তাদের অগ্রগতি যে আছে, সেই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “তাদের এই সময়ে যে অগ্রগতি ঘটেছে, আর বিএনপির যে সংকট, তাতে হবে কি, গ্যাপটা কমে এসে এমন একটা রেজাল্ট বেরুতে পারে যে দুটো দলকে সরকার গঠন করার জন্য বিভিন্ন ছোটখাটো দলকে হাতড়াতে হচ্ছে। এরকম একটা আশঙ্কা করা যায়।”
তার মতে, আওয়ামী লীগ অভ্যুত্থানে বিতাড়িত হলেও ভোটারদের একটি ‘বড় অংশ’ ওই দলের সমর্থক। সে কারণে আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে আয়োজিত নির্বাচন জনগণ ও বহিঃবিশ্বের কাছে ‘অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে’।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে অন্য কোনো নেতৃত্বের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হলে ভোটের ফল একটু ‘অন্যরকম’ হতে পারে বলে মনে করেন মোজাম্মেল হোসেন।
তিনি বলেন, “এমন হবে যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জামায়াত হয়তো থার্ড পার্টি, এটা আমার অনুমান। আওয়ামী লীগ, বিএনপির কোনো একটা দল বেশি ভোট পাবে, জামায়াত এক নম্বর হবে এটা আমি মনে করি না। এই হল আমার মোটামুটি অনুমান।”
বিএনপি বড় দল হলেও রাজনৈতিকভাবে নীতিকৌশলকে খুব স্পষ্ট করে দেশে শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক।
তিনি বলেন, “তারা মুক্তিযুদ্ধেও আছে, ধর্মেও আছে। হ্যাঁ, তারা সংবিধানে থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়াতেও আছে, আবার ধর্মের সুযোগ নিয়ে জামায়াতকে একটা গালি দেওয়াতেও আছে। ফলে বিএনপির মূল রাজনৈতিক ভিত্তিটাই কিন্তু নড়বড়ে হয়ে আছে।”
‘ইউনূসের এত তাড়া কীসের?
বন্দরের কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে দেওয়ার ভাবনা আওয়ামী লীগ সরকারেরও ছিল। কিন্তু এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ‘তারাহুড়ো’ দেখছেন মোজাম্মেল হোসেন।
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ খুব ধীর গতিতে চলছিল। ইউনূস সাহেব যেমন পড়িমরি দিতেই হবে, আওয়ামী লীগের তো তা ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগের সময় এই আলোচনা ছিল। আমি এটাকে খুব অস্বাভাবিক কিছু মনে করব না। এখন যেটা অস্বাভাবিক, সেটা হচ্ছে ইউনূসের এত তাড়া।”
এ বিষয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নীরবতা তাদের ‘রাজনৈতিক কৌশলগত দুর্বলতার ফল’ মন্তব্য করে এই বিশ্লেষক বলেন, “আমি মনে করি যে বিএনপি বা জামায়াত এই সময় অন্তত এই কথাটা বলতে পারত যে বন্দর সংক্রান্ত চুক্তির ব্যাপারে আরো স্বচ্ছতা চাই। এটা জনগণকে জানিয়ে করতে হবে এইটুকু বলতে পারত। সেটাও তারা বলেনি।”
রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব আরো বেশি ‘স্ট্রেট ফরোয়ার্ড’ হওয়া উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সেটা আমরা বিএনপি-জামায়াতের কাছে পাইনি বন্দর প্রশ্নে।”
‘মাইনাস টু, মাইনাস ফোর’
দুই নেত্রীকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়ার সেই ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা এখন ‘মাইনাস ফোর’-এ পরিণত হয়েছে কি না, সেই আলোচনা কয়েক দিন ধরে চলছে।
এ বিষয়ে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “আমি মনে করি যে মাইনাস টু ব্যাপারটা অলিক নয়, এটার একটা ভিত্তি ছিল। সেই ভিত্তিটা তৈরি করেছিল কিছু বিদেশী শক্তি, সেই শক্তিগুলো–যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি খুব সহানুভূতিশীল নয়–তারা।
“আর দেশের ভেতরের অরাজনৈতিক প্রভাবশালী কিছু মহল, সেনাবাহিনীর মধ্যে কোনো মহল, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কোনো মহল, আমলাতন্ত্রের মধ্যে কোনো মহল, তাদের মধ্যে এরকম একটা মাতব্বরি চিন্তা ছিল যে ‘জনগণ ভোট দেবে সেটা পরের কথা, আমরা আগে প্লাস মাইনাস করি’।… ফলে আমি বলি যে ‘মাইনাস টুর’ ভিত্তি ছিল।”
আর ‘মাইনাম ফোর’ ফর্মুলা প্রশ্নে তিনি টানলেন বড় দুটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বিতীয় প্রজন্মের ‘দেশের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকার’ প্রসঙ্গ।
“আমরা দেখি যে রাজনীতির সঙ্গে (তাদের) সম্পর্ক নাই। জয় এখানে ফিল্ডের রাজনীতি করতে চান না, কিন্তু মায়ের পরে প্রধানমন্ত্রী হতে চান। ১৭ বছর একজন বিদেশে আছেন, তিনি বলেন কী, ‘আমি নিজের ইচ্ছায় দেশে আসতে পারি না।’ তিনি মনে করেন যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাকে লাল গালিচা বিছিয়ে আনতে হবে। এগুলি কিন্তু পশ্চাৎপদতা এবং আমাদের দেশের মানুষের জন্য দুর্ভাগ্যজনক।”
রাজনীতির মতলব
সংবিধান সংস্কারের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রের মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার উদ্যোগের কঠোর সমালোচনা করেন মোজাম্মেলন হোসেন।
তার ভাষায়, ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে বাংলাদেশে রাষ্ট্রের ‘অস্তিত্বের যৌক্তিকতা’ থাকে না।
“তাহলে আমরা পাকিস্তানে থাকতে পারতাম। আমাদের যে অভিযোগ বা ঝগড়াঝাটি আমাদের ভাইদের সাথে ছিল, আমরা যদি মনে করি যে ধর্মনিরপেক্ষতা দরকার নাই, আমরা দ্বিজাতিতত্বে বিশ্বাস করি, তবেও পাকিস্তানে থাকতে পারতাম। পাকিস্তানে যে থাকতে পারিনি, তার মানেই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা দরকার এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ হয়েছে।”
তিনি বলেন, “সেটি বাদ দিয়ে এখন যেটা দাঁড়াল, আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি বামেরা দুর্বল। এখন হল ডান এবং বেশি ডান। মানে ডানপন্থি হল বিএনপি, যারা ধর্মেও আছে জিরাফেও আছে।
“আর ধর্মভিত্তিক দল তারা ঠিক করতে পারে না… তারা বলে মেয়েদের পোশাকে আমরা হাত দেব না, মেয়েদের পাঁচ ঘণ্টা কাজ হবে এসবও বলে; আবার বলে শরীয়া আইন অনুযায়ী আমরা দেশ চালাব; আবার হিন্দু শাখা করে, হিন্দু লোককে আইনসভার নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য নমিনেশন দেয়, আর বলে শরীয়া আইন করব। কাজেই ওখানে ধর্মটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন না, রাজনীতির মতলবটাই গুরুত্বপূর্ণ।”





