ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস এখন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলার পূর্ণাঙ্গ শুনানির আয়োজন করবে।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার তোলা আপত্তি ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) নাকচ হয়ে যাওয়ায় জাতিসংঘের এ সর্বোচ্চ আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলায় পূর্ণাঙ্গ শুনানির পথ তৈরি হয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমারকে এই বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। তাতে আপত্তি তুলে মিয়ানমার দাবি করেছিল, আইসিজেতে তাদের বিরুদ্ধে এ মামলা করার এখতিয়ারই গাম্বিয়ার নেই।
নেদারল্যান্ডসের হেগে শহরে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস গত ২১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে শুনানি করে। তার ভিত্তিতে শুক্রবার মিয়ানমারের আপত্তি নাকচ করে জাতিসংঘের এ আদালতের ১৩ বিচারকের প্যানেল সিদ্ধান্ত দিয়েছে, ১৯৪৮ সালের আন্তর্জাতিক জেনোসাইড কনভেনশনে সই করা সব দেশেরই দায়িত্ব হল গণহত্যা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখা। আর সেসব দেশ যখন কোথাও গণহত্যার অভিযোগ করে, তার ওপর শুনানি করার এখতিয়ার এ আদালতের রয়েছে।
সার সংক্ষেপে বলা হয়, জেনোসাইড কনভেনশনে সই করা দেশ হিসেবে এ আদালতে মামলা করার এখতিয়ার গাম্বিয়ার আছে।
রয়টার্স লিখেছে, ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস এখন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলার পূর্ণাঙ্গ শুনানির আয়োজন করবে, যার নিষ্পত্তি করতে বহু বছরও লেগে যেতে পারে।
পাঁচ বছর আগে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযানে যে বর্বরতা চালানো হয়, তার মধ্য দিয়ে দেশটি ১৯৪৮ সালের আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশন ভঙ্গ করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে গাম্বিয়ার করা মামলায়।
গাম্বিয়ার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল বাংলাদেশের একটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করার পর দেশটি এই মামলা করে। মিয়ানমারে চালানো গণহত্যা রোধ ও রক্তপাত বন্ধে এই মামলায় ৫৭ জাতির সংগঠন ওআইসির সমর্থন রয়েছে।
জাতিসংঘের আলাদা একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, ২০১৭ সালে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর অভিযানের পর ৭ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। মিয়ানমারের এই নির্যাতন ছিল ‘গণহত্যামূলক কাজ’।
আইসিজেতে মামলা হলে আদালতের সিদ্ধান্ত মানার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে সদস্য দেশগুলোর ওপর। তবে সেই রায় মানতে বাধ্য করার কোনো ক্ষমতা নেই এ আদালতের। সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করারও বহু উদাহরণ রয়েছে।
এ আদালত কোনো ব্যক্তিবিশেষকে সাজা দিতে পারে না, যেমনটি পারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। আইসিসি আলাদাভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যার ঘটনা তদন্ত করছে।
জাতিসংঘের আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচারের পথ খুললো
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শুনানির ভিত্তিতে পরের বছর রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় মিয়ানমারকে জরুরি ভিত্তিতে চার দফা অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছিল আইসিজে।
সেখানে বলা হয়েছিল, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বা কোনো পক্ষ এমন কিছু করতে পারবে না, যা গণহত্যা হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। গণহত্যার অভিযোগের সমস্ত আলামত তাদের সংরক্ষণ করতে হবে।
কিন্তু তার পরের দুই বছরে দেশটির পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফিরিয়ে নেয়নি। বরং রাখাইনসহ সেদেশের বিভিন্ন এলাকায় জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের নতুন নতুন খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মিয়ানমারের নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চি নিজেই নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের পিস প্যালেসে উপস্থিতি থেকে দেশটির সরকারের পক্ষে শুনানি করেন, যিনি সেনাঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর কয়েকটি মামলায় দণ্ড ভোগ করছেন।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা এখনও নাগরিকত্ব ও চলাচলের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত। দেশটির সরকারের নিপীড়নে বাস্তুচ্যুত কয়েক হাজার মানুষ এক দশক ধরে নোংরা ক্যাম্পে জীবনযাপন করছে।
অধিকার কর্মী ও রোহিঙ্গারা বলছেন, পরিকল্পিত নিগ্রহের বাতাবরণ থেকে তাদের মুক্ত করার সত্যিকার কোনো চেষ্টা তারা দেখতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিকে ‘সিস্টেমেটিক’ বৈষম্য হিসেবে বর্ণনা করছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।