কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে জাপান যেভাবে শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়েছে, তাকে ‘মডেল’ হিসেবে নিয়ে বাংলাদেশকেও উন্নত-সম্মৃদ্ধ দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মঙ্গলবার বিকালে টোকিওর একটি হোটেলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয়োজিত এক নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, “জাতির পিতা বলতেন, জাপানের অর্থনীতি মূলত ছিল কৃষিভিত্তিক। এই কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকেই কিন্তু জাপান একটা শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয় এবং একসময় বিশ্বের সব থেকে শক্তিশালী শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে জাপান প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।
“জাতির পিতা সবসময় বলতেন, আমাদের যেমন কৃষি রাখতে হবে, সাথে সাথে আমরা দেশকে শিল্পোন্নত করব, ঠিক জাপান যেভাবে করেছে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জাপান একটা মডেল আমাদের কাছে। জাপানের উন্নয়নকে মডেল হিসেবেই আমরা মনে করি। জাপান আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। জাপানে আমাদের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে জাপানের বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চমৎকার সম্পর্ক।”
‘দ্য ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনে যোগ দিতে মঙ্গলবার বিকেলে টোকিও পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার এ সম্মেলনে যোগ দিয়ে তিনি এশিয়ার সম্ভাবনা ও উত্থান নিয়ে নিজের ভাবনার কথা তুলে ধরবেন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও তাত্ত্বিকদের সামনে।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ছাড়াও ‘আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি’ হিসেবে পরিচিত মাহাথির মোহাম্মদ, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন এবং ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে অংশ নেবেন এ সম্মেলনে।
প্রধানমন্ত্রী এ সফরে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন; তাদের উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে আড়াই বিলিয়ন ডলারের একটি ঋণ চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে।
টোকিওর নিউ ওটানি হোটেলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, “জাপান আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ। আমরা সবসময় মনে করি আমাদের পাশে জাপান আছে।”
মহেশখালীর মাতারবাড়ি, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারসহ দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় জাপানি বিনিয়োগের কথা এ সময় প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরেন। পাশাপাশি অতীতে বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে জাপানি বিনিয়োগের কথাও তিনি বলেন।
প্রতিবার সরকারে আসার পর নিজের জাপান সফরের কথাও অনুষ্ঠানে বলেন বাংলাদেশের চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তার সরকারের সময়ে বিভিন্ন খাতে দেশের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এখন আমাদের দেশে কাজ করলেই টাকা। কেউ যদি একটু কষ্ট করে কাজ করতে চায়, তাহলে কিন্তু সে অর্থ উপার্জন করতে পারে। সেই সুযোগটা আমরা সৃষ্টি করেছি। এবং এই সুযোগটা আরও হবে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “দেশে আমরা ১০০টা অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি। সেখানে বিনিয়োগ হবে, কর্মসংস্থান হবে, উৎপাদন বাড়বে, মানুষের জীবনমান উন্নত হবে। আমরা সেদিকে লক্ষ্য রেখে কাজ করছি।”
জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ডিজটাল খাতের উন্নয়নের বিস্তারিত চিত্র প্রধানমন্ত্রী এ অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।
প্রবাসীদের বিশ্বে সন্মান নিয়ে চলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “অবৈধভাবে (বিদেশে) আসার কোনো প্রয়োজনই নেই। আমি নিজে দেখেছি, অনেকে ঘরবাড়ি, সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে যখন প্রবাসের পথে যাত্রা শুরু করে…।”
যারা কাজ নিয়ে বিদেশে যেতে চায়, তাদের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করা এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক করার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জমিজমা বিক্রি না করে ওই প্রবাসী ব্যাংক থেকেও টাকা নিতে পারবে।”
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়ন এখন গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত চলে গেছে। সুতরাং কেউ যেন অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টায় নিজেকে ধ্বংসের পথে নিয়ে না যায়।
তিনি বলেন, দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সবজি, ফলমূল, মিঠা পানির মাছ, ধান উৎপাদনে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। সরকার এখন ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিতে কাজ করছে।
অথচ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে বাংলাদেশকে ‘জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিল’ বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “প্রজন্মের পর প্রজ্ন্ম যখন আসবে তারা যেন সুন্দর জীবন পায়। আমরা যেমন কষ্ট ভোগ করেছি, এদেশের মানুষকে যেন সেরকম কষ্ট আর ভোগ করতে না হয়। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই ডেল্টা পরিকল্পনা করেছি।”
শেখ হাসিনা বলেন, “যে জাতির জন্য আমার বাবা, মা, ভাইয়েরা জীবন দিয়ে গেছেন, সেই জাতির কল্যাণের জন্য আমার কাজ করতে হবে, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হবে।”
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদানের কথাও এ অনুষ্ঠানে স্মরণ করেন সরকারপ্রধান।
জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতেমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমেদ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বক্তব্য দেন
প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে তার সঙ্গে রয়েছেন তার ছোট বোন শেখ রেহানা, অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তাফা কামাল, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু।