আগামী কয়েক মাসের মধ্যে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর সংস্কারপন্থি নেতারা।
শনিবার ঢাকার একটি হোটেলে দলটির বহিষ্কৃত নেতা মজিবুর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ‘জনআকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ স্লোগানের একটি মঞ্চের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের ঘোষণা আসে, যা তাদের রাজনৈতিক দল গঠনের প্রাথমিক পদক্ষেপ।
মঞ্জু বলেন, “আমরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করব। আলোচনা, পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে আমরা সংগঠনের নাম, কাঠামো, কর্মপদ্ধতি ঠিক করব। আজ থেকে আমাদের কাজ শুরু হল।
পূর্ণাঙ্গ দল গঠনে পাঁচটি কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এসব কমিটি তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। আপাতত এই উদ্যোগ সমন্বয়কের দায়িত্ব এই নাখান্দাকে দেওয়া হয়েছে।”
এসব কমিটিতে দেশে-প্রবাসে কর্মরত তাদের মতের সঙ্গে সম্পৃক্ত চিন্তাধারার মানুষ এবং বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন বলে জানান তিনি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নে আগামী তিন মাসের মধ্যে নতুন দল নিয়ে সক্রিয় হওয়ার আশাও প্রকাশ করেন মঞ্জু। তিনি বলেন, “আমরা যত তাড়াতাড়ি পারি যথা শিগগিরই আসব।”
ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মঞ্জু একসময় চট্টগ্রাম কলেজ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরেরও সভাপতি ছিলেন। গত বছর বহিষ্কৃত হওয়ার আগে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য ছিলেন তিনি।
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর চাপে পড়া জামায়াত তাদের শীর্ষনেতাদের দণ্ডিত হয়ে ফাঁসিতে ঝোলার পর কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এর মধ্যে একটি অংশ দলে সংস্কারের দাবি তোলে।
কয়েক মাস আগে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাক একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চেয়ে জামায়াত ছাড়ার ঘোষণা দিলে সংস্কারপন্থিরা আরও জোর পায়।
তখনই রাজ্জাকের মতো মত প্রকাশের জন্য দল থেকে বহিষ্কৃত হন মঞ্জু; তারপর তিনি বিকল্প দল গঠনের উদ্যোগ নেন, যা শনিবার প্রকাশ্যে আনলেন তিনি।
তবে তিনি দাবি করেন, নতুন দল গঠনের এই উদ্যোগের সঙ্গে বিদেশে থাকা রাজ্জাকের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পালনের পর জামায়াতের নীতি-নির্ধারণী ফোরামে স্থান পাওয়া মঞ্জু বলেছেন, তারা ধর্মভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করবেন না।
“আমরা কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছি না। আমরা যে রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছি, তা হবে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য।”
জামায়াতসহ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিজেদের নতুন দলের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেন তিনি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নে মঞ্জু বলেন, তাদের এই উদ্যোগের পেছনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কোনো মদদ নেই।
বাংলাদেশ এখন ‘অধিকারহীন, অনিরাপদ ও স্বৈরতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
যুদ্ধাপরাধের চলমান বিচার প্রশ্নে মঞ্জু বলেছেন, তারা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে এই বিচার নিষ্পত্তির দাবি জানাচ্ছেন।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে শীর্ষ নেতারা একে একে দণ্ডিত হওয়ার পর জামায়াত বলছিল, এই বিচার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে হচ্ছে না।
নির্দিষ্ট ১৯টি বিষয়ে একমত হয়ে তারা সবাই এই উদ্যোগে শামিল হয়েছেন জানিয়ে মঞ্জু বলেন, তারা নির্দিষ্ট আদর্শভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করছেন না, জনগণের আকাঙ্ক্ষাভিত্তিক দল গঠন করবেন।
‘এই রাজনৈতিক দল হবে ইতিবাচক বাংলাদেশ গড়ার নতুন কার্যক্রম।”
সাংবাদিকদের প্রশ্নে জামায়াতকে নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অনীহা প্রকাশ করে মঞ্জু বলেন, “অতীতের বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চাই না। যেহেতু অতীত থেকে আমরা বর্তমানে এসে উপস্থিত হয়েছি, বর্তমানের চিন্তা নিয়েই থাকতে চাই। এখন সংস্কার বলে আমাদের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই, কোনো চিন্তাও আমাদের নেই।”
তবে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, “মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী একমাত্র দল না হলেও পরবর্তী সময়ে জামায়াতের ভূমিকা নিয়েই বেশি প্রশ্ন ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে।”
মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার দায় স্বীকারের আহ্বান জামায়াত নেতৃত্ব অগ্রাহ্য করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এই রাজনৈতিক অবস্থানের বোঝা একাত্তর পরবর্তী প্রজন্মের বহন করা উচিৎ নয় বলে আমরা বিশ্বাস করি।”
মঞ্জু লিখিত বক্তব্যে বাংলাদেশের ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবুল হাশিম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে খাজা নাজিমুদ্দীনকেও স্মরণ করেন।
তিনি বলেন, “ঔপনিবেশিক আমলে গভীর সংকটকালে জাতিকে নতুন পথ দেখিয়েছিল মুসলিম লীগ ও দ্বিতীয় পর্য়ায়ে আওয়ামী লীগ। আর স্বাধীন বাংলাদেশে তেমন এক ক্রান্তিকালে হাল ধরেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, অভ্যুদয় ঘটেছিল বিএনপির।”
যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের আইনজীবী তাজুল ইসলামও এই সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন।
মঞ্জুর উদ্যোগের সঙ্গে শামিল হওয়ার কথা জানিয়ে তাজুল দাবি করেন, তিনি আগে জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। পেশাগত কারণে তিনি জামায়াত নেতাদের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছিলেন।
বিজয় একাত্তর হোটেলে এই সংবাদ সম্মেলনে মঞ্জুর পাশে তাজুল ছাড়াও ছিলেন অধ্যাপক আবদুল হক, গোলাম ফারুক, সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মোস্তফা নূর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন, মাওলানা আবদুল কাদের, নাজমুল হুদা অপু, মো. সালাউদ্দিন, ব্যারিস্টার জোবায়ের আহমেদ ভূইয়া, আবদুল হক প্রমুখ।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী নাজিমউদ্দিন আল আজাদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়র অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, নুরুল ইসলাম ভূইয়া ছোটন, গৌতম দাশ, রুবী আমাতুল্লাহ, সুকৃতি কুমার মণ্ডলও এই অনুষ্ঠানে ছিলেন।