জাল জামিনাদেশ তৈরি করে ১৭ বছর ছিলেন মুক্ত জীবনে। আড়াই কেজি হেরোইন পাচারের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার এক বছরের মধ্যে ভয়ংকর এই তিন আসামি বেরিয়ে যান কারাগার থেকে। এই কারামুক্তির ক্ষেত্রে আসামিরা ব্যবহার করেছেন উচ্চ আদালতের জাল জামিনাদেশ। ঐ জামিনাদেশ দাখিলের পরই তারা যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে যান প্রায় দেড় যুগ আগে। জামিনে মুক্ত হওয়ার পর আবারও জড়িত হন হেরোইন পাচারের সঙ্গে। দায়ের হয় আরেকটি হেরোইন পাচারের মামলা। ঐ মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে হাজির হন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি গোলাম মোস্তফা।
তিনি দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে আরেকটি হেরোইন মামলা হয়েছিল। সেই মামলায় তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন। কিন্তু কোনো জামিনাদেশ দেখাতে পারেননি। এর পরই তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। এরপর চলতি বছর জামিন চান হাইকোর্টে। বেরিয়ে পড়ে থলের বেড়াল। বিস্ময় প্রকাশ করেন হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চের দুই বিচারপতিও। তারা দেখতে পান, হাইকোর্টের কোনো ধরনের রায় বা আদেশ ছাড়াই জাল জামিনাদেশ তৈরি করে মুক্তি পেয়েছেন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত এই তিন আসামি। এরা হলেন—গোলাম মোস্তফা, আবু বকর ও জালালউদ্দিন। তিন জনই বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
এদিকে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন বেঞ্চের নামে সৃজনকৃত ২২টি জামিন জালিয়াতির মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে। এই তিন আসামির জামিন জালিয়াতিসহ দুটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা বুধবার আদালতে হাজির হয়ে তদন্তের অগ্রগতি বিষয়ে সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায় তাদের ভর্ত্সনা করেছে হাইকোর্ট।
আদালত বলেছে, আমাদের আদেশকে কি আপনারা হালকাভাবে নিচ্ছেন? এ ধরনের জামিন জালিয়াতির সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি ও মর্যাদার বিষয়টি জড়িত। আদালতের আদেশকে অবমাননা করবেন না। যদি করেন, তখন আদালত অবমাননার দায়ে চাকরি বাঁচাতে পারবেন না। এখন দেখুন চাকরি বাঁচাবেন, না জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করবেন? একই সঙ্গে ১২ জুলাইয়ের মধ্যে তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছে বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সামিরা তারান্নুম মিতি। এদিকে হাইকোর্টের এমন কঠোর মনোভাবের পর বগুড়ার এক মামলায় জামিন জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ঢাকা জজকোর্টের আইনজীবী রাজু আহমেদ রাজীবকে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে সোপর্দ করেছেন তার আইনজীবী। আসামির আইনজীবী মো. ওজিউল্লাহর উদ্দেশে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরেও আপনি এই আসামির পক্ষে আইনি লড়াই করতে এসেছেন। বারের একজন নেতা হিসেবে আপনার কাছে এমনটা প্রত্যাশা করি না। আগে আসামিকে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হবে।’ এরপরই ওজিউল্লাহ আসামি অ্যাডভোকেট রাজুকে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে সোপর্দ করেন।
যেভাবে মুক্তজীবনে সাজাপ্রাপ্ত তিন আসামি
আড়াই কেজি হেরোইন পাচারের মামলায় ২০০১ সালের ১ সেপ্টেম্বর মাগুরার শালিখা থানায় তিন জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৯(১)(খ) ধারায় করা মামলায় আসামি গোলাম মোস্তফা, আবু বকর ও জালালউদ্দিনকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করে মাগুরার আদালত। দণ্ডিত তিন আসামিকে ২০০৩ সালের ৪ মার্চ প্রথমে মাগুরা কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর ঐ বছরের ৮ মার্চ পাঠানো হয় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। ঐ কারাগারে থাকাবস্থায় সাজার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন আসামিরা। কিন্তু ঐ আপিল শুনানি না করেই হাইকোর্টের জাল জামিনাদেশ সৃজন করেন আসামিরা। এরপর তা নিম্ন আদালত হয়ে যায় কারাগারে। ঐ জাল জামিনাদেশের কপি পেয়ে ২০০৪ সালের ১৮ এপ্রিল দণ্ডিত তিন আসামিকে মুক্তি দেয় কারা কর্তৃপক্ষ।
মুক্তি পেয়ে আবারও হেরোইন পাচারে
কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে আবারও হেরোইন পাচারে জড়ান আসামিরা। এক কেজি হোরোইন পাচারের একটি মামলা বিচারাধীন ছিল ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এ। এই মামলায় ২০১৬ সালের ৭ এপ্রিল হাজিরা দেন গোলাম মোস্তফা। তখন তিনি আদালতে বলেন, আড়াই কেজি হেরোইন পাচারের মামলায় তিনি দণ্ডিত হয়ে হাইকোর্টের জামিনে আছেন। কিন্তু কোনো কাগজ দাখিল করতে পারেননি। এর পরই তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। পরে ২০০৩ সালে দায়েরকৃত আপিলে হাইকোর্টে জামিন চান। তখন জাল জামিনাদেশ সৃজন করে কারাগার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রকাশ পায়। এর পরই বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ৮ মার্চ বিষয়টি তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেয়। ঐ নির্দেশের পরই জালিয়াতির প্রমাণ পায় তদন্ত সংস্থাটি।
এছাড়া গত এপ্রিল মাসে জালালউদ্দিন ও আবু বকরকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একই সঙ্গে জামিন জালিয়াতিতে কারা জড়িত এবং কারাগারের কোনো কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে কি না, তা তদন্তে তিন সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি কাজ করছে। বর্তমানে খুলনা বিভাগে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় কমিটির অনুসন্ধান বন্ধ রয়েছে।
দুই তদন্ত কর্মকর্তাকে ভর্ত্সনা
হাইকোর্টের নির্দেশে আদালতে হাজির হন হেরোইন পাচারের জামিন জালিয়াতির মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) সিআইডির মামনুর রশিদ। আদালত বলেন, এই তিন আসামিকে কি জামিন জালিয়াতির মামলায় গ্রেফতার দেখিয়েছেন? আইও বলেন, এখনো চাইনি। কাল রিমান্ড চাইব। আদালত বলেন, জালিয়াতির মামলায় গ্রেফতার না দেখিয়ে কীভাবে রিমান্ড চাইবেন? এতদিন পরেও কেন তাদের শ্যোন অ্যারেস্ট দেখাননি। আমরা কি এখানে বসে কীভাবে মামলার তদন্ত করতে হবে সেটা আপনাদের শেখাব? আদালত বলেন, আসামিদের শ্যোন অ্যারেস্ট করে রিমান্ডে নিন। তারপর জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে বের করুন কার মাধ্যমে তারা জামিন জালিয়াতির আদেশ পেল। এর সঙ্গে কারা জড়িত সেটা বের করার জন্যই আপনাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বগুড়ার এক মামলায় জামিন জালিয়াতি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সুলতান হোসেনকে সতর্ক করেছে হাইকোর্ট। আসামি গ্রেফতার করতে না পারায় আদালত তাকে সতর্ক করে দেন। তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে বলেন, আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। কিন্তু মোবাইল ফোন বন্ধ রাখায় তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আদালত বলেন, আপনি (আইও) হাইকোর্টে দাঁড়িয়ে আছেন। সেখান থেকে ১০০ গজের মধ্যে আসামি অবস্থান করছে। আপনি আসামি খুঁজে পাচ্ছেন না। এরপরই আসামি রাজুকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবন থেকে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে সোপর্দ করেন তার আইনজীবী ওজিউল্লাহ। গত ৯ ফেব্রুয়ারি বগুড়ায় মোটর মালিক গ্রুপের অফিস দখল নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনার মামলায় জাল জামিনাদেশ দিয়ে ৩০ আসামিকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়।
==============================================================================
এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ ২৭ জুন