সিরিজ শুরুর আগে মাঠের বাইরের আলোচনাই ছিল বেশি। মাঠের ক্রিকেটে দুর্দান্ত অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে বাংলাদেশ বদলে দিল আবহ। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয়টা ছিল প্রত্যাশিতই, বড় স্বস্তি হয়ে এলো দাপুটে জয়। লিটন দাসের সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশের স্কোর উঠল রেকর্ড উচ্চতায়। পরে বোলাররা দলকে এনে দিলেন রেকর্ড গড়া জয়।
সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে সিলেটে জিম্বাবুয়েকে ১৬৯ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ।
ওয়ানডেতে বাংলাদেশের আগের সবচেয়ে বড় জয় ছিল ২০১৮ সালে মিরপুরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৬৩ রানের জয়।
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে রোববার ৫০ ওভারে বাংলাদেশ তোলে ৩২১ রান। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এটি নিজেদের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ। জিম্বাবুয়ে গুটিয়ে গেছে ১৫২ রানে।
বাংলাদেশের ইনিংসের প্রাণ ছিল লিটনের ১০৫ বলে ১২৬ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগোতে থাকা ওপেনারকে ফেরাতে পারেনি জিম্বাবুয়ের কোনো বোলার। ছক্কা মারার সময় পায়ে টান লাগায় খুঁড়িয়ে মাঠ ছাড়েন তিনি।
ম্যাচ থেকে বাংলাদেশের চাওয়ার যা কিছু ছিল, মিলেছে তার প্রায় সবই। ফেরার ম্যাচে নাজমুল হোসেন শান্ত বড় ইনিংস খেলতে পারেননি, তবে ব্যাটিংয়ে ছিল আত্মবিশ্বাসের ছাপ। মোহাম্মদ মিঠুন করেছেন ঝড়ো ফিফটি, মাহমুদউল্লাহ খেলেছেন কার্যকর ইনিংস।
শেষ ওভারে তিন ছক্কায় দারুণ এক ক্যামিও খেলেছেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। দীর্ঘ চোট কাটিয়ে ফেরার ম্যাচে এই অলরাউন্ডার পারফরম্যান্সকে পূর্ণতা দিয়েছেন পরে দারুণ বোলিংয়ে ৩ উইকেট নিয়ে।
লম্বা সময় পর দেশের জার্সিতে খেলতে নেমে মাশরাফি বিন মুর্তজা অবশ্য বল হাতে ক্ষুরধার ছিলেন না। ম্যাচ অনুশীলনের ঘাটতি ফুটে উঠেছে তার বোলিংয়ে। তবে ৫ ম্যাচের খরা কাটিয়ে দুটি উইকেটের দেখা পাওয়া তাকে দেবে স্বস্তি।
টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমেছিল বাংলাদেশ। অনুমিতভাবেই উইকেটের ঘাস ছেটে ফেলা হয় অনেকটা। সবুজের খানিকটা ছোঁয়া অবশ্য ছিল উইকেটে। তাতে ব্যাটিংয়ের জন্য ভালো হয়েছে আরও, বল এসেছে ব্যাটে।
দুই ওপেনারের শুরু ছিল দুই রকম। প্রথম ওভারেই দারুণ টাইমিংয়ে চার মেরে শুরু করেন লিটন। এগিয়ে যান অনায়াসে। তাকে ন্যূনতম ভোগাতে পারেনি কোনো বোলার। তামিম ইকবালের ব্যাটিংয়ে ছিল অস্বস্তি। আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল স্পষ্ট। ধুঁকেছেন প্রান্ত বদলাতে।
পাওয়ার প্লের ১০ ওভার শেষে তামিমের রান ছিল ৩১ বলে ১৫। উদ্বোধনী জুটির পঞ্চাশ আসে একাদশ ওভারে।
তামিমের ভোগান্তি শেষ করেছেন অভিষিক্ত অফ স্পিনার ওয়েসলি মাধেভেরে। ৪৩ বলে ২৪ করে এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরেছেন দলের একমাত্র রিভিউ নষ্ট করে।
দলের ইনিংস গতি পায় পরের জুটিতে। শান্ত ছিলেন সাবলীল। লিটন তো ততক্ষণে জমে গেছেন। উইকেটে দুজনের বোঝাপড়া ছিল দারুণ। এক-দুই এসেছে ক্রমাগত। আলগা বল পেয়েছে সাজা। মাধেভেরেকে বেরিয়ে এসেছে ছক্কায় উড়িয়েছেন শান্ত, ডেনাল্ড টিরিপানোকে হুক করে।
৭৭ বলে ৮০ রানের জুটি থেমেছে আম্পায়ারের ভুলে। ইমপ্যাক্ট ছিল অফ স্টাম্পের বেশ বাইরে, তবু এলবিডব্লিউ দেন আম্পায়ার। ছিল না কোনো রিভিউ। ৩৮ বলে শান্তর রান ছিল ২৯।
লিটন ৪৫ বলে ছুঁয়েছিলেন ফিফটি। শতরান ছুঁতে লেগেছে ৯৫ বল। ডনাল্ড টিরিপানোকে ফ্লিকে বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে পা রাখেন কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়।
৩৪ ওয়ানডেতে লিটনের এটি দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে চোখ ধাঁধানো সেই ইনিংসের পর আবার স্বাদ পেলেন শতরানের।
সেঞ্চুরির পর হয়ে উঠছিলেন আরও ভয়ঙ্কর। টিরিপোনোর এক ওভারে আদায় করেন তিনটি বাউন্ডারি। মাধেভেরেকে ৯০ মিটার লম্বা ছক্কায় আছড়ে ফেলেন বাইরে। ওই শট খেলতে গিয়ে পায়ে লাগে টান।
মুশফিকুর রহিম ফিরে যান তার আগেই। নিরীহ এক ডেলিভারি গ্লাইড করতে গিয়ে ক্যাচ দিয়েছেন উইকেটের পেছনে।
তবে দলকে পথ হারাতে দেয়নি মাহমুদউল্লাহ ও মিঠুনের জুটি। ৬৮ রান যোগ করেছেন দুজন ৫৭ বলে।
২৮ বলে ৩২ এসেছে মাহমুদউল্লাহর ব্যাট থেকে, পঞ্চম ওয়ানডে ফিফটিতে ৪১ বলে ৫০ মিঠুন।
ঝড়ো ব্যাটিংয়ে শেষটা করেন সাইফ। ক্রিস এমপোফুর করা শেষ ওভারে তিন ছক্কাসহ ১৫ বলে অপরাজিত ২৮ করেছেন লম্বা চোট কাটিয়ে ফেরা অলরাউন্ডার। শেষ ১০ ওভারে বাংলাদেশ তুলেছে ৯৪ রান।
জিম্বাবুয়ের এই ব্যাটিং লাইন আপের জন্য রানটা ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরেই। লড়াই জমানোর মতো কিছুও তারা করতে পারেনি।
রান তাড়ায় প্রয়োজন ছিল উড়ন্ত শুরু। উল্টো জিম্বাবুয়েকে চেপে ধরেন সাইফ ও মুস্তাফিজুর রহমান। ফেরার ম্যাচে প্রথম ওভারেই উইকেট নেন সাইফ। ৬ ওভারে জিম্বাবুয়ের রান ছিল ১ উইকেটে ১২!
সেই চাপ থেকে তারা আর বের হতে পারেনি। মাশরাফি ফেরান প্রতিপক্ষ অধিনায়ক চিবাবাকে। চাকাভাকে ফিরিয়ে সাইফ ধরেন দ্বিতীয় শিকার। ৫ ওভারের প্রথম স্পেলে তিনি রান দিয়েছেন কেবল ৬।
মিডল অর্ডারের দুই ভরসা ব্রেন্ডন টেইলর ও সিকান্দার রাজা দলকে উপহার দিতে পারেননি তেমন কিছু।
ম্যাচ থেকে জিম্বাবুয়ের প্রাপ্তি মাধেভেরের পারফরম্যান্স। সদ্য যুব বিশ্বকাপ খেলে আসা অলরাউন্ডার বোলিংয়ের পর ব্যাটিংয়েও রেখেছেন প্রতিভার ছাপ। দলের সর্বোচ্চ ৩৫ এসেছে তার ব্যাট থেকেই।
চাপে থাকা মেহেদী হাসান মিরাজ বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার রসদ পেয়েছেন দুই উইকেট নিয়ে। ম্যাচের সমাপ্তি হয়েছে মাশরাফির হাত ধরে। অধিনায়ক হিসেবে ছুঁয়েছেন শততম উইকেট। জিম্বাবুয়ে খেলতে পারেনি ৪০ ওভারও।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ৩২১/৬ (তামিম ২৪, লিটন ১২৬ (আহত অবসর), শান্ত ২৯, মুশফিক ১৯, মাহমুদউল্লাহ ৩২, মিঠুন ৫০, সাইফ ২৮*, মিরাজ ৭, মাশরাফি ০*; এমপোফু ১০-০-৬৮-২, মুম্বা ৮-০-৪৫-১, মাধেভেরে ৮-০-৪৮-১, টিরিপানো ৭-০-৫৬-১, রাজা ১০-০-৫৬-০, মুটুমবোদজি ৭-০-৪৭-১)।
জিম্বাবুয়ে: ৩৯.১ ওভারে ১৫২ (কামুনহুকামউই ১, চিবাবা ১০, চাকাভা ১১, টেইলর ৮, মাধেভেরে ৩৫, রাজা ১৮, মুটুম্বামি ১৭, মুটুমবোদজি২৪, টিরিপানো ২, মুম্বা ১৩, এমপোফু ৯*; মুস্তাফিজ ৬-০-২২-১, সাইফ ৭-০-২২-৩, মাশরাফি ৬.১-০-৩৫-২, তাইজুল ৯-২-২৭-১, মিরাজ ৮-১-৩৩-২, মাহমুদউল্লাহ ৩-০-১২-০)।
ফল: বাংলাদেশ ১৬৯ রানে জয়ী ।
সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ১-০তে এগিয়ে ।
ম্যান অব দা ম্যাচ: লিটন দাস ।