পঁচাত্তর পরবর্তী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের ওপর গবেষণার জন্য পরিচিত সাংবাদিক জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেছেন, তখনকার সামরিক আদালতের বিচারকরা আগে লেখা রায় পাঠ করতেন, যাতে জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্বাক্ষর থাকত।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনী প্রধান হন জিয়াউর রহমান, পরে তিনিই হন বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় ১৯৭৮ সালে তার তত্ত্বাবধানেই বিএনপির প্রতিষ্ঠা হয়।
ডিবিসি নিউজ টিভি চ্যানেলের সম্পাদকদের একজন পিন্টু বলেন, “জিয়ার আমলে সশস্ত্র বাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধা শুন্য করতে ব্যাপক হারে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।”
‘অন্ধকারের ওই দিনগুলো’ আরও খতিয়ে দেখতে একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেন পিন্টু, তার এই প্রস্তাবে সমর্থন জানান সাবেক প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম ও শহীদ বুদ্ধিজীবী আব্দুল আলিম চৌধুরীর মেয়ে নুজহাত চৌধুরী।
“সশস্ত্র বাহিনীর অন্ধকার দিনগুলো সম্পর্কে জানার অধিকার রয়েছে মানুষের,” বলেন এই গবেষক।
শনিবার বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট অডিটোরিয়ামে সিআরআইয়ের আয়োজনে ‘ইতিহাসের অবরুদ্ধ অধ্যায়: ১৯৭৫-১৯৯৬’ শীর্ষক আলোচনা সভায় কথা বলেন তারা।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী শাহ আলী ফরহাদের সঞ্চালনায় সভায় ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট মারুফ রসুলও বক্তব্য দেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের পর জন্ম নেওয়া তরুণ-তরুণীরাই এই সভার দর্শক সারিতে ছিলেন।
পঁচাত্তর পরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ে ১৯৯৭ সালে একটি বই প্রকাশিত হয় জায়েদুল আহসান পিন্টুর।
জিয়াউর রহমানের আমলে সামরিক আদালতের বিচার কার্যক্রম নিয়ে তিনি বলেন, “বিচারকরা বলেছেন, জিয়া আদেশে সই করতেন। তারা শুধু সেগুলো পড়ে যেতেন।”
ওই সময় নিহতদের পরিবারের সদস্যরা এখনও তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন বলে জানান পিন্টু। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, হাসানুল হক ইনু সম্প্রতি সংসদে বক্তব্যে ওই সব হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে পিন্টু জানেন বলে উল্লেখ করার পর ৪২ বছর বয়সী এক ব্যক্তি তার অফিসে আসেন।
“কিছু বলার আগে ১০-১২ মিনিট কান্নাকাটি করেন তিনি। তারপর বলেন, আমি আপনার কাছে এসেছি আমার বাবার মৃত্যুর তারিখটা জানতে। আমার গবেষণার সব নথিপত্র ঘেঁটে তাকে বললাম, এটা ছিল ২৭ নভেম্বর এবং আপনার বাবাকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। শুনে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
“এটা শুধু একটা উদাহরণ মাত্র। আপনি ওই সব দিন কল্পনাও করতে পারবেন না।”
পিন্টু বলেন, “প্রতি রাতে শহরে কারফিউ থাকত এবং কেন্দ্রীয় কারাগারে রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত ফাঁসি দেওয়া হত। তালিকা ছিল দীর্ঘ এবং সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ সারত তারা।
“একজনকে ফাঁসি দিতে ৩০ মিনিট সময় নিত । এক রাতে তারা আটজনকে ফাঁসি দিতে পারত। সে কারণে অনেককে কুমিল্লা, বগুড়া ও রাজশাহী কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। মৃত্যু ত্বরাণ্বিত করতে তারা রগও কেটে দিত। আমার কাছে প্রমাণও আছে, এটা নিছক গবেষণাই নয়।”
তিনি বলেন, “কুমিল্লা কারাগারে ফাঁসি কার্যকরকারীর সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, ৯২ জনকে ফাঁসি দিয়েছেন। বাংলাদেশে মোট ৪৮০টি ফাঁসির মধ্যে জিয়াউর রহমান ২৮০ জনকে ফাঁসি দিয়েছেন এবং তারা সবাই সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য।”
পিন্টু বলেন, এত দ্রুত এই প্রক্রিয়া শেষ করা হত যে যাকে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে কি না তাও যাচাই করার সময় থাকত না তাদের। যাবজ্জীবন দেওয়া একজনকেও ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।
“‘আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি…,’ বলে কাঁদতে থাকেন তিনি। কিন্তু তাদের যাচাই করারও সময় ছিল না।”
তিনি বলেন, “একটি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল ৮ অক্টোবর, কিন্তু রায় ঘোষণার তারিখ ছিল ৭ অক্টোবর। ওই রায় কার্যকর করা হয় ৯ অক্টোবর। আর ট্রাইব্যুনাল গঠনের গেজেট হয়েছিল ১৪ অক্টোবর।
“প্রতিটি কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, জেনারেল জিয়া ডাইনিং টেবিলে এক হাতে কাঁটাচামচ নিয়ে আরেক হাতে মৃত্যুদণ্ডের আদেশে সই করতেন। এমনকি বিদেশে যাওয়ার পথে বিমানবন্দরেও তিনি স্বাক্ষর করতেন।
“তিনি এটা করতেন দ্রুত ফাঁসি কার্যকর করার জন্য। এটা ছিল একটি নিয়মিত বিষয়।”
পিন্টু বলেন, “বিএনপি নেতা মীর শওকত আলী তাকে বলেছেন, তারা সেনাবাহিনীর এক হাজার ১৩০ জনকে হত্যা করেছেন, যাদের ৯০ শতাংশের বেশি মুক্তিযোদ্ধা।
“তার (জিয়া) মিশন ছিল, মুক্তিযোদ্ধা সৈন্যদের নিঃশেষ করা। মুক্তিযোদ্ধা নন এমন কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতেন তিনি।”
নুজহাত চৌধুরীও অন্ধকার এই অধ্যায়ের বিস্তারিত জানতে একটি কমিশন গঠনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, “১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিলেন তাদের নিঃশেষ করতে চেয়েছিলেন জিয়া। এই ষড়যন্ত্র এখনও চলছে। প্রতিটি পেশায়ই তারা কৌশলে এই কাজ করে।
“আমাদের দেখতে হবে, তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর চর হিসেবে এখানে কাজ করেছিলেন কি না।”
১৯৭১ সালের বুদ্ধিজীবী হত্যা, ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ড এবং পঁচাত্তর পরবর্তী সশস্ত্র বাহিনীতে হত্যাকাণ্ড খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দিয়ে এই কমিশন করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“এটা করার জন্য এখন সুবর্ণ সুযোগ। পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস জানার জন্যই আমাদের এই কমিশন দরকার।”
তারানা হালিম বলেন, জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করেছিলেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন করেছিলেন।
“তিনি ১২ হাজার বিচারাধীন মামলা বাতিল করেছিলেন এবং ৪৭৫ জন দণ্ডিত অপরাধীকে মুক্তি দিয়েছিলেন। যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দিয়ে তাকে পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন।”