ছোট্ট মেয়ের কাছে বাবা মানেই সীমাহীন ভালবাসার ঝাঁপি, বাবা তার নিরাপত্তার অতন্দ্র প্রহরী। আহ্লাদী আবদারের জন্য মেয়ের কাছে বাবা আলাদীনের চেরাগের ভেতরে সেই ম্যাজিক দৈত্য, যে কচি মনের ছোট ছোট আশাগুলো চাইলেই পূরণ করতে পারে। বাবা, মাথার ওপর শান্ত-কমল-নিরাপদ আকাশ। শান্তি আর নির্ভরতার আশ্রয়স্থল। বাবা বিশাল এক বটগাছের শীতল ছায়া, খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে যার বুকে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়া যায়- দু:স্বপ্নের ভয় না করেই।
ছোট্ট চোখে বাবা হিমালয় পর্বতের সমান বিশাল, যে তার পরিবারকে বিপদ-আপদ-ভয় থেকে বুক দিয়ে আগলে রাখেন। ছোট্ট মনে বাবাই তার অ্যাকশন মুভির সুপার হিরো, বাবা পাশে থাকলেই যেন ছুঁতে পারেনা কোনও মুশকিল, থাকে না আর জুজুর ভয়।বাবারা যুগে যুগে দুনিয়ার সমস্ত শিশু কন্যার হৃদয়ের প্রথম ভালবাসা…
আমারও একজন বাবা ছিলেন। সন্তানের জন্য ভালবাসায় ভরপুর, পরিপূর্ণ একজন বাবা। সংসারে রাজপুত্রের মত চার ছেলে, তারপরও বাবা-মায়ের মন মেয়ের আশায় আকুল। মেয়ে নাকি সংসারের আলো, বন্ধন, শক্তি আর মায়া। মেয়ে ছাড়া কি ঘর সুন্দর হয়? বাবা-মায়ের আশা আর দোয়া কবুল হয়ে ভাইদের বেশ পর এলো আমার বড় বোন, আরও কিছুকাল পর আমি। আদরে-আহ্লাদে, ভালবাসায় ভরে গেল বাবা মায়ের মন।
আম্মা আর ভাইদের কাছে শুনেছি বাবা ছিলেন অসম্ভব এক আদর্শ পিতা। সন্তানদের সাথে অতি সহজ সরল বন্ধুর মত সম্পর্ক ছিল তার। ভাইরা ছেলেদের স্বভাবজাত নিয়মেই দুষ্টুমি করলে, আম্মা চাইতেন বাবা ওদের শাসন করুক। কিন্তু তিনি কখনো কাউকে ভুলেও স্বাভাবিক নিয়মে শাসন করেননি। সেই দায়িত্ব আম্মা নিজ হাতে তুলে নিলেও সেটা তার খুব অপছন্দ ছিল।
তার শেখানোর কৌশলটা ছিল দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে, উদাহরণ দিয়ে। নিজে প্রচুর পড়াশোনা করতেন, জ্ঞান অর্জনে তার কোনও ক্লান্তি ছিল না। জ্ঞানই শক্তি- এই ছিল তার জীবনের মূলমন্ত্র। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা কোনও নেতার এ এক অসাধারণ গুণ! নিজের এ গুণটি বাচ্চাদের মাঝেও ছড়িয়ে দিতে চাইতেন আর তাই তাদের হাতেও তুলে দিতেন বই।
আমার খুব ছোটবেলায় কিছু স্মৃতি আবছা মনে আছে। মাঝে মাঝে রাতে বাবা আমাকে ঘুম পাড়াতেন শরৎচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথ পড়ে। (ওসব বোঝার বয়স তখনো আমার হয়নি, কিন্তু একটু বড় হয়ে যে-ই নিজে পড়তে শিখলাম, খুব আগ্রহ আর ভালবাসা জন্মালো সেই বইগুলোর প্রতি।)
বাবার দরাজ গলায় গল্প কবিতা পড়া শুনতে শুনতে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তাম। তিনি তখন আবার ব্যস্ত হয়ে পড়তেন কাজে। আমার বাবা ছিলেন প্রচারবিমুখ মানুষ। নীরবে কাজ আর দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি। আমার বড় ভাই সৈয়দ আশরাফ ও ছিলেন বাবারই মত এবং আমরাও অনেকটা তাদেরই মত। তাই অনেকেরই এ মহান মানুষটি সম্বন্ধে খুব বেশি জানা নেই।
বাবার অনেক কথা, অনেক গল্প- জেনেছি আম্মা ও পরিবারের বিভিন্ন জনের কাছে। আবার বিভিন্ন সময়ে তার খুব কাছের মানুষ আর রাজনৈতিক সহকর্মী, সহযোদ্ধাদের অনেকের কাছেও সেই ছোটবেলা থেকেই অনেক শুনেছি কি অসাধারণ ছিলেন তিনি।
কিন্তু তা বরাবর নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছি। এখন মনে হয় এসব কথা তো একটি পরাধীন দেশের স্বাধীনতা অর্জনের অগ্রণী নেতৃত্বে যারা ছিলেন সেসব মহান মানুষের জীবনের কথা, তাদেরই জীবনযাপন! তাদের চিন্তাধারা এবং চরম আত্মত্যাগের গল্পগুলোই তো বাংলার ইতিহাস। লক্ষ শহীদ মুক্তিযাদ্ধা আর সম্ভ্রমহারা মা-বোনের কথা আর সত্য গল্পগুলোই তো বাংলাদেশর জন্মের ইতিহাস।
নতুন এবং আগামী প্রজন্মের কছে এসব নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তারা যত বেশি জানবে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের কথা, এই মানুষগুলো আর তাদের অক্লান্ত জীবন সংগ্রামের কথা, তাদের চূড়ান্ত ত্যাগের কথা, ততই তো তারা মহান মুক্তিযুদ্ধকে, স্বাধীনতার শক্তিকে বুকে ধারণ করে দেশটাকে সত্যিকারভাবে ভালবাসতে শিখবে। দেশ গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ হবে।
এ ভাবনা থেকেই এতকাল পরে এসে আরো নিবিড়ভাবে বাবার সম্বন্ধে জানবার চেষ্টা করছি। আর যতই জানছি, অবাক হচ্ছি… কী করে একজন মানুষের এত প্রতিভা থাকে, এত অল্প সময়ের জীবনে ন্যায়নীতিতে অটল থেকে কী করে এতটা সফল হয়!
কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করেননি তিনি। নীতির সাথে, নেতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। মাথা উঁচু রেখে, জেনে বুঝে অবধারিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিয়েছেন নির্ভয়ে।
আমার বাবা স্কুল কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে সব ধরনের স্পোর্টস এ চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। ক্রিকেট, ফুটবল, হকি ও লন টেনিসের তুখোড় প্লেয়ার ছিলেন তিনি। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লু’ পদক দেওয়া হয়েছিল তাকে। একাধারে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ও তুখোড় খেলোয়াড় হওয়া সহজ কথা নয়, তিনি তাই ছিলেন।
প্রচুর ব্যস্ততার মাঝেও তিনি খেলাধুলা করতেন আমার ভাইদের সাথে। বাবা নিজে তাদের শিখিয়েছেন ক্রিকেট, লন টেনিস, ব্যাডমিন্টন, দাবা ইত্যাদি খেলা।
দর্শন, আদর্শ, ন্যায়, নীতি, মনুষ্যত্ব, মূল্যবোধ এসব শিখিয়েছেন নিজের কাজের দৃষ্টান্তে। শুনেছি আমার ভাইরা যখন ছোট, বাবা তাদের সাথে নিয়ে বসে সকালে চায়ের সাথে দেশ-বিদেশের খবরের কাগজ পড়তেন আর তারপর তাদের সাথে রাজনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস ও খেলাধুলা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করতেন বড়দের মত। অন্য বাবা-মায়েরা সাধারণত ওই বয়সে বাচ্চাদের সাথে স্কুলের পড়া নিয়েই ব্যস্ত থাকেন।
আর এভাবেই তিনি বাচ্চাদের পাঠ্য বইয়ের বাইরে জীবনের সত্য ও বাস্তব থেকে শেখাতে চাইতেন। আমার ভাই-বোনেরা সবাই অত্যন্ত মেধাবী এবং যার যার জায়গায় সুপ্রতিষ্ঠিত।
আমাদের সবার জন্য বাবার দেয়া একটা আদুরে নাম ছিল। আমার বোন যেহেতু আমার দাদু আর বাবার মত দেখতে তাকে আদর করে ডাকতেন ‘মাও (মা) বেটি’ আর আমাকে আদর করে বলতেন ‘আমার বাঘুনী (বাঘীনি) বেটি’ বলে। (আম্মার কাছে শোনা) অনেক ছোট্ট আমাকে কাজে যাওয়ার আগে সুযোগ পেলেই কোলে নিয়ে আদর করে করে নানাভাবে রাগিয়ে দিতে চেষ্টা করতেন। যদিও আমি, আম্মার কথা অনুযায়ী খুব ‘লক্ষ্মী’ বাবু ছিলাম তবু বাবার চেষ্টা বৃথা যেত না। অবুঝ শিশু হঠাৎ রেগে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে খামচে দিতাম বাবার বুকে-মুখে। বাবা খুব মজা পেয়ে আত্মতৃপ্তিতে দরাজ গলায় হা-হা করে হাসতেন আর পরম মমতায় বলতে থাকতেন- ‘আমার বাঘুনি বেটি’ বলে।
হয়ত এভাবেই তিনি আমাদের শিশুবয়স থেকেই যেকোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ করা শেখাতে চাইতেন। আমার নাম রেখেছিলেন বাবা নিজের মায়ের নামে, দাদুর নাম ছিল রুপা।
আমাদের বাবা সাধারণ একজন মানুষ নন, তিনি ছিলেন অসাধারণ। কিশোরগঞ্জের যশোদল ইউনিয়নের বীর দামপাড়ার স্বনামধন্য সাহেব বাড়ির সৈয়দ পরিবারে বহু বছর প্রতীক্ষার পর আমার দাদুর কোল আলো করে এসেছিলেন আমার বাবা।
ফুটফুটে গোলাপের মত সুন্দর শিশু, আদর করে ডাক নাম রাখা হলো- গোলাপ।
অন্যান্য সব বাচ্চার থেকে অনেকটা আলাদা ছিলেন খুব ছোট বয়স থেকেই। আমার অসম্ভব ধার্মিক দাদু আর আর বাবার মহিয়সী মা বুঝতে পারতেন মহান কোনও দায়িত্ব পালনেই তাদের এ ‘গোলাপ’ এর জন্ম।
ছাত্রজীবনে মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠনের কর্মী ছিলেন। ১৯৪৭ সালে বঙ্গবন্ধুর সাথে তার প্রথম দেখা হয় সিলেটের গণভোটের সময়। তখন থেকেই শুরু একে অপরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাভরা নিবিড় বন্ধুত্বের।
পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র থাকাকালীন বাবা ঐতিহ্যবাহী এসএম হলের ভিপি নির্বাচিত হন। সেই সময়কার ছাত্র যারা ছিলেন তারা জানেন ওটা তখন কত বড় একটা বিষয়।
শুধু বলিষ্ঠ নেতৃত্ব গুণের অধিকারী অসাধারণ ছাত্ররাই সে পদের জন্য যোগ্য বিবেচিত হতেন। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপির নেতৃত্বে চারজন ছাত্রনেতা তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে স্মারক লিপি দিয়েছিলেন, আমার পরম শ্রদ্ধেয় বাবা তাদের একজন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তঝরা আন্দলনের বহু আগেই এ প্রস্তাব করা হয়েছিল। অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অনেক আগেই সৈয়দ নজরুল সরাসরি যুক্ত ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সাথে। সক্রিয় রাজনৈতিক আন্দোলন ও খেলাধুলার সাথে পুরোপুরি সংযুক্ত থেকেও তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে শেষ করেন (ইতিহাসে এম এ) পড়াশোনা।
ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী আনন্দমোহন কলেজে ইতিহাস বিভাগে শিক্ষকতার পদে যোগ দিয়ে শুরু তার কর্ম জীবনের। শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় বহুবার বাবার অসংখ্য প্রাক্তন ছাত্র/ছাত্রী যারা কিনা বিভিন্ন মত, ধারার এবং ভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ, তারা পরম শ্রদ্ধায় বলেছেন কী অসাধারণ শিক্ষক, ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব ছিলেন আমার বাবা।
কর্মজীবনের শুরুতেই বাবার সাথে মায়ের বিয়ে হয়। মা অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও অর্থনৈতিকভাবে ধনবান পরিবারের ছয় ভাইয়ের সবার ছোট এবং ভীষণ আদরের একমাত্র বোন।
আমার মা আমার চোখে দেখা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম মায়েদের একজন। মায়ের কথা বলা শুরু করলে আর থামতে পারবো না, তাই ওনার কথা অন্য সময় বলবো। শুধু এটুকুই বলতে চাই- আমার বাবার অসাধারণ ও বিপ্লবী জীবনের একেবারে আদর্শ সাথী ছিলেন আমার মা। আমার ন্যায়পরায়ণ বাবাকে অত্যন্ত অন্যায়ভাবে হারানোর পর, সেই অল্পবয়সে ছোট্ট আমাদের নিয়ে একা আমার মা। বড় দুই ছেলে কাছে নেই। তারা বিদেশে, নির্বাসনে। দেশে ফিরে আসার সব পথ তাদের জন্য বন্ধ। এক ছেলে সেসময়ই কেবল শুরু করেছিল সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ। কী তার অবস্থা জানা নেই। ছোট ভাই স্কুলের ছাত্র, তখনো ছোট। কোন অর্থ নাই, বিত্ত নাই, কী করে সংসার চালাবেন, আর কিভাবেই বা মানুষ করবেন ছোট্ট বাচ্চাদের …
আমি নিশ্চিত পাহাড়ের মত দুশ্চিন্তা সেসময় তার মাথায়। তার উপর স্বামী হারানোর অসহ্য ব্যাথা। কিন্তু কারো সাহায্যের মুখাপেক্ষী হননি তিনি।
বাবার রেখে যাওয়া একমাত্র সম্বল আমাদের ময়মনসিংহের বাসায় বাচ্চাদের নিয়ে আশ্রয় নিলেন। অসীম ধৈর্য আর সাহসের সাথে পরিবারটিকে বাবার স্মৃতি নিয়ে- তার আদর্শে, নৈতিকতায় বাঁচিয়ে রেখে বড় করে মানুষ করে তুলতে অক্লান্ত সংগ্রাম করে গেছেন। জীবন সংগ্রাম করে গেছেন জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত।
অধ্যাপনার সাথে সাথে আমার বাবা সেই সময়কার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিযোগিতামূলক সিএসপি (বোধ হয় এখনকার বিসিএস) পরীক্ষা সম্মাননার সাথে পাস করেন ও আয়কর কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। আমার দাদা ছেলের কৃতিত্বে অসম্ভব খুশি আর গর্বিত হলেন।
এ কাজে যোগ দেয়ার অল্প সময়ের মধ্যে বাবার চোখে পরে তাদের দুর্নীতির চিত্র, যা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। প্রতিবাদ করতে গিয়ে দেখলেন এবং বুঝতে পারলেন এ দুর্নীতির শেকড় অনেক গভীরে যুক্ত এবং তার একার পক্ষে তা শোধরানো সম্ভব নয়।
তখনই তিনি সেই চাকরি ছেড়ে দিলেন। নীতির সাথে আপস না করে নিজের মতো করে সোচ্চার প্রতিবাদ করলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কাউকে কিছু না বলেই তিনি চাকরি ছেড়েছিলেন, আর সেদিন নাকি খুব খুশি মনে মিষ্টি কিনে বিলাতে বিলাতে বাসায় ফিরেছিলেন!
এই হচ্ছেন আমার বাবা! নীতি, আদর্শ আর চরিত্রের কি অসীম দৃঢ়তা ছিল তার মধ্যে। তার সন্তান হিসাবে ধন্য আমরা। এত বড় আর সম্মানের চাকরি ছেড়ে দেয়ায় দাদা ভীষণ রাগ করলে, তাকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে শান্ত করলেন বাবা।
নিজের মা-বাবাকে অসম্ভব সম্মান করতেন তিনি, আর তার বাবার মতের বিরুদ্ধে কখনো কিছু করেননি।
এরপর তিনি আম্মার উত্সাহে ও আমার বড় মামা মাসুদুজ্জামানের সাথে পরামর্শ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। বরাবরের মত আবারো অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে আইন পাস করে ১৯৫৫ সালে ময়মনসিংহ বারে আইনজীবী হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হন। তিনি দ্রুতই সফল আইনজীবী হিসেবে বিশেষ পরিচিতি ও প্রসার লাভ করেন।
এই সময়ই বঙ্গবন্ধুর একান্ত ইচ্ছা ও ইঙ্গিতে এবং ময়মনসিংহের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া এবং সামসুল হকের একান্ত প্রচেষ্টায় বাবা জাতীয় রাজনিতির সাথে যুক্ত হন।
সেসময় জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে, তখনকার জাঁদরেল নেতা, প্রাক্তন মন্ত্রী ও সুসাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদকে পরাজিত করে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৬৪ সালে পঞ্চম সম্মেলনে পুর্ব পাকিস্থান আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ সভাপতি নির্বাচিত হন এবং মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ নির্বাচিত হন সভাপতি।
১৯৬৬ সালের ১৮-১৯ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বিশেষ সভায় সভাপতি মাওলানা তর্কবাগীশ অনুপস্থিত থাকায় সৈয়দ নজরুল সেই সভার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে সেদিন বাঙালির মুক্তির সনদ ছয়দফাকে দলীয়ভাবে অনুমোদন করা হয়। সভাপতির ভাষণে সৈয়দ নজরুল ৬ দফাকে বাঙলার প্রত্যেক ঘরে ঘরে পৌছে দেওয়ার আহ্বান জানান। সেদিন থেকেই দলের প্রত্যেক পর্যায়ের নেতাকর্মী ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পরে।
১৯৬৬ সালের ৯ মে থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত দলীয় ও জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে সৈয়দ নজরুল, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা, যেমন- ১৯৬৯ এর তীব্র গণআন্দোলনের মাধ্যমে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধুর নি:শর্ত মুক্তির প্রক্রিয়া তার নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় ও সফল হয়।
১৯৬৯ এর ফেব্রুয়ারি ও মার্চে পাকিস্তান প্রতিনিধিদের সাথে যে গোলটেবিল বৈঠক হয় বাবা তার সাথেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় যুক্ত ছিলেন।
জাতির ক্রান্তিলগ্নে ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর সাথে ও তার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অত্যন্ত দক্ষতা আর নিষ্ঠার সাথে তার প্রতিটি দায়িত্ব পালন করেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সথে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপে। ১৯৭০ সালের ৪-৫ জুনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু সভাপতি এবং সৈয়দ নজরুল সিনিয়র সহ সভাপতি নির্বাচিত হন।
৫ জুন ১৯৭০ এ নির্বাচনকে সামনে রেখে গঠিত পার্লামেন্টারি বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য নির্বাচিত হন এবং সেই নির্বাচনে ময়মনসিংহ ১৭ আসনে জাতীয় পরিষদের সদস্য ও দলীয় সংসদীয় উপনেতা নির্বাচিত হন তিনি।
আর দশটা শিশু যেভাবে তার বাবাকে কাছে পায়, সেভাবে আমি আমার বাবাকে পাইনি; কারণ আমি আসার অনেক আগেই তিনি মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন একটি অসহায় নির্যাতিত পরাধীন জাতিকে স্বাধীন করবার সংগ্রামে। শুধু তার একান্ত পরিবারের জন্য নন, ততদিনে তিনি একটা পরাধীন দেশের সাড়ে সাত কোটি নিপীড়িত মানুষের ‘সুপার হিরো’।
অনেক কাজ তার, অনেক ব্যস্ততা…। বাবা ছিলেন অসহায় বাংলাকে পরাধীনতার শেকল খুলে স্বাধীন করবার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নসারথী। তিনি ছিলেন তার ‘মুজিব ভাই’ এর অত্যন্ত আস্থাভাজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ভাই এবং সহযোদ্ধা…। আমার বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, যাকে বাংলার মানুষ পরম শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় ডাকতো বাংলার ‘বুলবুল বলে।
আর বঙ্গবন্ধু (বয়সে বড় হয়েও) থেকে শুরু করে দলের প্রায়ই সবাই বাবাকে পরম শ্রদ্ধাভরে ডাকতেন ‘স্যার’ বলে। একথা আগে আমি অনেকবার অনেকের কাছে শুনেছি। আর খুব সম্প্রতি শুনেছি আমাদের শ্রদ্ধেয় মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ কাকুর কাছে।
আমার বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭১ সালে গঠিত বাংলাদেশের মুজিবনগরের বৈদ্যনাথতলায় গঠিত সর্বপ্রথম সরকারের সর্বপ্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি।
পরিবারে ৬ ভাই বোনের সবার ছোট আমি। জীবনকে ভালো মত বোঝার আগে, বাবা আমাদেরকে কতোটা কি তা বোঝা বা জানার আগেই- ক্ষমতালোভী কুচক্রিমহল ৭৫ এর ১৫ অগাস্ট সপরিবারে জাতির জনককে নির্মম নৃশংসভাবে হত্যার পর, বাবাসহ জাতীয় চার নেতাকে কারাবন্দি করে। তারপর ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরে জেলখানার চারদেয়ালে বন্দি সে নেতাদের দুনিয়ার সমস্ত নিয়মনীতি ভঙ্গ করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। নির্দয়ভাবে কেড়ে নেয় আমার সীমাহীন ভালবাসার ঝাঁপি। আমার পরম নিরাপদ আশ্রয়স্থল। বাবার বুকটা ঝাঁজরা করে দিয়েছিলো ব্রাশফায়ার করে…
আমি সেদিন ঠিক মত বুঝতেও পারিনি কি ভয়ানক কাণ্ড হয়ে গেছে। আমরা সেদিন ছিলাম সেজ মামার আরমানি টোলার বাসায়। শুধু নিরব, অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেছি অনেক মানুষের আসা-যাওয়া, অনেক কান্নার রোল। মৃত্যু কী- জানা নেই তখনো, কিন্ত ভাল লাগছিল না। মাঝে মাঝে মামার বাসার ভেতরের উঠানটায় এদিক-ওদিক অসহায় চোখে লুকিয়ে থাকার একটু জায়গা খুঁজছিলাম। চোখ বন্ধ করে যেন মনে মনে পালাতে চাচ্ছিলাম বহুদূরে কোথাও।
তারপর বহু বছর পর্যন্ত ঘুমালে আমার একটাই স্বপ্ন ছিল, তা হলো আমার বাবা অগণিত মানুষের মিছিলে সহস্র ফুলের মালা গলায় হাস্যজ্জ্বল মুখে দুহাত বাড়িয়ে আমায় বুকে জড়িয়ে ধরতে এগিয়ে আসছেন, আর আমি বাবার জন্য দুহাত বাড়িয়ে তাকে ছোঁয়ার অপেক্ষায়…
সে অপেক্ষায় থাকি এখনো আমি।
কী তাদের অপরাধ ছিল? কী অন্যায় তারা করেছিলেন?
অপরাধ তাদের ছিল একটাই, তা হচ্ছে নিজের অসহায় পরাধীন মাতৃভূমি আর তার নিপীড়িত মানুষকে নি:শর্তভাবে ভালবাসা। তাদের রক্ত ছিল দেশের মাটির মত পবিত্র ও খাঁটি; মীরজাফরের মতো কলুষিত বেঈমান রক্তে- দূষিত নয়।
১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরও লোভী-খুনিদলের রক্ত পিপাসা পরিতৃপ্ত হয়নি। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি চেয়েছিল ছলেবলে কৌশলে লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে স্বাধীনতার চার পরমশক্তিকে দলে টানবার, কিন্ত কিছুতেই পারলোনা।
আম্মার কাছে জেনেছি, আমার বাবাকে খুনি খন্দকার মোশতাক নিজে টেলিফোন করলে কে কল করেছে বুঝতে না পেরে বাবা রিসিভ করেন। এক দুই মুহূর্ত তিনি চুপ করে শোনেন। মোশতাক তাকে লোভ এবং ভয় দেখাতে চেষ্টা করে রিসিভারের অপর প্রান্ত থেকে। সদা শান্ত স্বভাবের বাবা আমার, ‘বেঈমান’- বলে হুংকার দিয়ে প্রচণ্ড রাগে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং টেলিফোনটাকে সজোরে আছড়ে ফেলেন। সেটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যায়। এরপরও বিভিন্নভাবে খুনি মোশতাক আমার আম্মার সাথে যোগাযোগ করার অব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যায়। এ বেঈমান, মীর জাফরের দল বুঝতে পারলো বাংলাকে নস্যাৎ করার নীলনকশায় কি সাংঘাতিক ভুল তারা করেছে! আর তখনই তারা আরো এক ভয়ানক ষড়যন্ত্র করলো; ভাবলো এই চার জাতীয় বীরকে শেষ করে দিলেই বুঝি তাদের ষড়যন্ত্র সফল হবে।
হিসাব তাদের সেদিনও ভুল ছিল। তারা কল্পনাও করতে পারেনি এক মুজিব, এক সৈয়দ নজরুল, এক তাজউদ্দীন, মনসুর আর কামারুজ্জামান এর পবিত্র রক্ত থেকে জন্ম হবে কোটি শেখ মুজিবের, সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন, মনসুর আর কামরুজ্জামানের…
স্বাধীনতা অর্জন করা যেমন কঠিন, স্বাধীনতা কেড়ে নেয়াও তেমনি কঠিন।
আজ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছেন, এগিয়ে যাচ্ছে সোনার বাংলা গড়ার কাজ অতি দ্রুত। তার সাথে সাথে দেশের সকল স্তরের জনগণ যদি যার যার অবস্থান থেকে নিজের মাতৃভূমিকে ভালবেসে সচেষ্ট থাকেন, তবে নিশ্চয়ই লাখো শহীদের রক্ত, সহস্র মা-বোনের সম্ভ্রম আর বহু মহান বীরের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন বাংলাদেশ একদিন সত্যিকারের সোনার বাংলায় পরিণত হবে।
সশ্রদ্ধ সালাম জানাই ইতিহাসের সকল বীর শহীদের প্রতি। সশ্রদ্ধ সালাম জানাই সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা আর দেশপ্রেমীদের প্রতি।
সৈয়দা রাফিয়া নূর রুপা