গেল আগস্টে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি সরকারের ভর্তুকি কমাতে সাহায্য করবে। অপরদিকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে কমতে পারে বিনিয়োগ। অর্থ বিভাগের কাছে এমন মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, আগামী দিনে রাজস্ব আহরণ আরও হ্রাস পাবে। ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি অর্থনীতিতে মারাত্মক আঘাত হানছে। সব মিলিয়ে বৈশ্বিক সংকটের একাধিক ধাক্কায় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি গভীর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাটি সম্প্রতি অর্থ বিভাগকে এসব তথ্য লিখিত আকারে জানিয়েছে।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, আইএমএফ সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয়ে নানা দিক জানতে চেয়েছে। অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে। ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তার প্রক্রিয়া হিসাবে ঢাকা সফর করছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। মিশনটি বুধবার ঢাকা ত্যাগ করার কথা। এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয়; জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়; বাংলাদেশ ব্যাংক; জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে।
সূত্র জানায়, দেশের অর্থনীতির সার্বিক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি অর্থ সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের সঙ্গে সংস্থাটির প্রতিনিধিরা বৈঠক করেছেন। আইএমএফ-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯-এর প্রভাব কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গতি ফিরে আসে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ফের আঘাত করে। এই যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বেড়েছে। পণ্যের সরবরাহ চেইনে বাধা সৃষ্টি এবং বৈশ্বিক চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। এর প্রভাবে চলতি হিসাবে ঘাটতি আরও বেড়েছে। পাশাপাশি টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। এছাড়া ক্রমাগত কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে অর্থনীতিতে আঘাত হেনেছে। আমদানি করতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে।
সংস্থাটি মনে করছে, এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপির প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বলা হয়, গত এপ্রিলে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদনে আইএমএফ-এর পর্যবেক্ষণ ছিল ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্জন করতে পারে। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি এ প্রবৃদ্ধির হার আরও কমবে। আইএমএফ মনে করছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৬ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০০২ থেকে ২০০৬ অর্থবছর পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল। কিন্তু ২০০৯ থেকে ২০২২ অর্থবছর পর্যন্ত এ প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এটি ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ অর্জন হবে।
আইএমএফ মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে বলেছে, ঊর্ধ্বমুখীর কারণে অভ্যন্তরীণ খাদ্যপণ্যের দাম বেশি। সংস্থাটি মনে করছে, চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়াবে ৯ দশমিক ১ শতাংশ। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী থাকবে। ওই বছর মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৮ শতাংশে বিরাজ করতে পারে। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এটা কমতে পারে বলে ধারণা দিয়েছে। তবে অর্থ বিভাগ থেকে জানানো হয়, ২০০৮ সালে মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এটি জুনে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ ওঠে। তবে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ১ শতাংশ।
আইএমএফ বাজেট ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাদের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বাজেট ঘাটতি চলতি অর্থবছরে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হবে। আর আগামী অর্থবছরে এটি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া চলতি ও আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায় কমবে। রাজস্ব আহরণ জিডিপির ১১ শতাংশ হবে এবং আগামী অর্থবছরে সেটি ১০ দশমিক ৯ শতাংশ হবে। এটি জিডিপির ৯ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে। তবে আগস্টে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করেছে সরকার। এতে সরকারের ভর্তুকি কিছুটা কমবে, যা স্বস্তিদায়ক। সরকারের পরিচালন ব্যয়ও কমবে।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আইএমএফ ৪৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ১৩০ কোটি ডলার দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। এজন্য বৈঠক শেষে আইএমএফ-এর একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসছে। এই ঋণের বিপরীতে ভ্যাট যৌক্তিককরণ, প্রশাসনিক অটোমেশন, ভর্তুকি টার্গেটসহ নানা ধরনের শর্ত দেওয়া হয়েছে। তবে খুব বেশি কিছু করতে হবে না। মোটা দাগে দুই থেকে তিনটি সংস্কার করলে এই ঋণ পাওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, এ মুহূর্তে আইএমএফ-এর ঋণ পেলে অনেক ভালো হবে। কারণ রিজার্ভ এখনো সংকটে আছে।