উইকেট দেখে চমকে উঠতে পারেন যে কেউ। চেহারা যে সবুজাভ! ম্যাচের আগের দিনের চিত্রের অবশ্য মূল্য আছে সামান্যই। ম্যাচের সকালে নিশ্চিতভাবেই মিরপুরের ২২ গজ হয়ে যাবে ন্যাড়া। তবে এটিও নিশ্চিত, ভয়ঙ্কর টার্নিং উইকেট এবার আর হচ্ছে না। নিয়মিত দেখা যাবে না সামনেও। জয়ের তৃষ্ণা দলের আছে বটে। তবে ঘরের মাটিতে স্পিন স্বর্গ তৈরির ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে চান রাসেল ডমিঙ্গো। বদলাতে চান বাংলাদেশের টেস্ট সংস্কৃতি।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মিরপুর টেস্ট দিয়েই সেই পালাবদলের সূচনা করতে চান বাংলাদেশ কোচ। মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে ম্যাচটি শুরু হবে শনিবার সকাল সাড়ে ৯টায়।
চন্ডিকা হাথুরুসিংহে কোচ থাকার সময় ২০১৬ সাল থেকে ঘরের মাটিতে টার্নিং উইকেট বানিয়ে ম্যাচ জয়ের পথ বেছে নিয়েছিল বাংলাদেশ। তখনকার অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের মাথায় এসেছিল ভাবনা, সায় দিয়েছিলেন কোচ। সেই পরিকল্পনাতেই ইংল্যান্ডকে প্রথমবার টেস্টে হারায় বাংলাদেশ, জয় ধরা দেয় আরেক প্রবল পরাক্রমশালী দল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও। হাথুরুসিংহে অধ্যায় শেষেও ২০১৮ সালে এই ছকে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ।
তবে এই সময়টায় দেশের বাইরে ধুঁকেছে বাংলাদেশ। পেস সহায়ক কন্ডিশন ও উইকেটেও দলের পেসাররা সুবিধা করতে পারেননি। সবশেষ আফগানিস্তানের বিপক্ষে চট্টগ্রামে চার স্পিনার নিয়েও বাংলাদেশ হেরে যায় শোচনীয়ভাবে।
দেশের বাইরে দুরাবস্থা আর ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বন্ধুর পথ মিলিয়েই এসেছে বদলের ভাবনা। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট শুরুর আগের দিন মিরপুরে সংবাদ সম্মেলনে ডমিঙ্গো স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, সব ম্যাচেই টার্নিং উইকেট আর নয়।
“টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশকে উন্নতি করতে হলে, সবসময় আমরা এমন ভীষণরকম টার্নিং উইকেটে খেললে হবে না। দেশে এক সিমার নিয়ে খেলে, এরপর ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে আমাদের তৃতীয় বা চতুর্থ সিমার খুঁজে হাপিত্যেশ করতে হয়। কারণ ওরা তো ম্যাচই খেলেনি!”
“ব্যাপারটিতে তাই ভারসাম্য আনতে হবে। আমরা জানি যে আমাদের দলের শক্তির জায়গা স্পিনিং উইকেটে খেলা, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলের বিপক্ষে। আমরা অবশ্যই চাইব উইকেটে স্পিন ধরুক। তবে ভালো উইকেটে খেলাও আমাদের শিখতে হবে, যেন সিমাররা ম্যাচে থাকে এবং ব্যাটসম্যানরা বড় রান করতে পারে।”
ভবিষ্যতের বৃহত্তর ছবির দিকে তাকিয়ে, কেমন উইকেটে খেলা উচিত, সেটি নিয়ে সংশয় নেই ডমিঙ্গোর।
“আমি চাই ভালো উইকেট। চাই, আমাদের সিমাররা প্রথম দিনে যথেষ্ট বোলিং করুক, স্পিনাররা ভূমিকা রাখবে তৃতীয়, চতুর্থ ও শেষ দিনে। প্রথম দিনে প্রথম সেশনের চ্যালেঞ্জ সামলে নিক আমাদের ব্যাটসম্যানরা। এরপর উইকেট তাদের জন্য সহজ হয়ে আসবে, পরে আবার কঠিন হবে।”
“বাংলাদেশ অবশ্যই ঘরের মাঠে স্পিনিং উইকেটে ভালো করেছে। কিন্তু দলের উন্নতির জন্য, বৃহত্তর ছবিটাও আমাদের ভাবনায় রাখতে হবে। টার্নিং উইকেটে খেললে অনেক সময় নিজের সম্পর্কে ভুল ধারণা দেয়। বোলাররা মনে করে, তারা দারুণ বোলার, কারণ বল স্পিন করছে। পেসাররা মনে করে, তারা ভালো নয়। আমি তাই এই ধারণায় প্রবল বিশ্বাসী যে, শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরে ভালো করতে হলে আমাদের ভালো উইকেটে খেলতে হবে। স্পিনিং উইকেটে খেলতে থাকলে আমরা যেখানেই সফর করব, কোনো সুযোগ থাকবে না।”
গত কিছুদিনে বাংলাদেশের যা পারফরম্যান্স, তাতে অবশ্য সংস্কৃতি বদলের চেয়ে বেশি জরুরি জয়। সবশেষ ৫ টেস্টের সবকটি হেরেছে বাংলাদেশ। ৪টিতে হার ইনিংস ব্যবধানে, আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২২৪ রানে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও জিততে না পারলে দেশের ক্রিকেটে নেমে যাবে আরও তিমিরে।
ডমিঙ্গোও সেই বাস্তবতা জানেন। তার কাছে তবু গুরুত্ব পাচ্ছে সংস্কৃতির বদল। শুধু উইকেটই নয়, টেস্ট ম্যাচের প্রস্তুতি থেকে শুরু করে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন দেখতে চান কোচ।
“জয় অবশ্যই চূড়ান্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমাদের টেস্ট সংস্কৃতি গড়ে তোলাও জরুরি। যেভাবে আমরা টেস্টের প্রস্তুতি নেই ও সূচি করি…(সেখানে বদল আনতে হবে)। এই টেস্টে আমি বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে যাচ্ছি, কারণ ৪-৫ দিন আমরা একসঙ্গে অনুশীলন করেছি।”
“(এখানে আসার আগে) আমি কখনোই এমন দেখিনি. কোথাও উড়ে গেলাম, গিয়ে একদিন অনুশীলন, তারপরই ম্যাচ! সামনে পাকিস্তানে যাব, একটি ওয়ানডে খেলে একদিন অনুশীলন করে আবার টেস্ট। কোনো সিরিয়াস টেস্ট দল এরকম সূচিতে খেলে না। আমাদের এসব বদলানোর চেষ্টা করতে হবে। এটি সংস্কৃতির ব্যাপার, টেস্ট ম্যাচে আমাদের আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।”
পাশে বসে কোচের কথার সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন অধিনায়ক মুমিনুল হকও।
“আমার মনে হয়, কোচ যেটা বলেছেন, সেই কৌশলেই এগোব আমরা। সবসময় একই কৌশলে থাকলে অন্য দলগুলি ধরে ফেলবে। পেস বোলার না খেলালে বাইরে গিয়ে খুব ভুগতে হয় আমাদের। তো এই জিনিসগুলো আস্তে আস্তে বের হচ্ছে আমার কাছে মনে হয়।”
জিম্বাবুয়ের অবশ্য সংস্কৃতি বা এত গভীর ভাবনা নেই। তাদের ভাবনা কেবল এই ম্যাচ ঘিরে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশকে তারা ভালো করেই জানে। আত্মবিশ্বাস তলানীতে থাকা দলকে তাই চেপে ধরতে চান তারা, বললেন অধিনায়ক ক্রেইগ আরভিন।
“টেস্টে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে বেশ বাজে সময় কাটাচ্ছে। নিজেদের কন্ডিশনে অবশ্যই তারা তুলনামূলক শক্তিশাশী দল। তবে এই কন্ডিশন আমাদেরও খানিকটা চেনা। প্রায়ই এখানে সফরে আসি আমরা, খুব অচেনা কন্ডিশন নয়। আশা করি, খুব ভালো লড়াই হবে।”
আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ নয় এই ম্যাচ। সেদিক থেকে খুব একটা গুরুত্ব নেই এই টেস্টের। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাম্প্রতিক বাস্তবতায় এই ম্যাচও মহামূল্য। অনেকটা চাপেরও। জিতলে খানিকটা স্বস্তির শ্বাস ফেলার সুযোগ মিলবে। জিততে না পারলে বাড়বে হাহাকার!