প্রকট ডলার সংকটের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ভোগ্যপণ্যের আমদানিতে। ডলারের অভাবে ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারকরা চহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পারছেন না। এতে এসব পণ্যের আমদানি যেমন কমেছে, তেমনই কমেছে এলসি খোলা। গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে নিত্যপণ্যের এলসি খোলা কমেছে ৪৪ শতাংশ। একই সঙ্গে আমদানি কমেছে ২৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। এর মধ্যে রোজানির্ভর পণ্যও রয়েছে।
সূত্র জানায়, রোজা শুরুর মাত্র দুই মাস বাকি। এসব পণ্যের কাঁচামাল দেশে এনে পণ্য তৈরি করে বাজারে দিতে দেড় থেকে দুই মাস সময় লাগে। এছাড়া তৈরি পণ্য দেশে আনতে হয় রোজার শুরুর ১৫ দিন থেকে এক মাস আগে। যে কারণে রোজানির্ভর পণ্যের এলসি খোলার হার আরও আগেই বাড়ানো উচিত ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন রোজানির্ভর পণ্য আমদানিতে ডলারের জোগান বাড়িয়েছে। ব্যাংকগুলো এসব পণ্যের এলসি যাতে দ্রুত খুলতে পারে, সে বিষয়েও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, এ খাতের পণ্য আমদানির এলসি খোলা বাড়বে।
রোজানির্ভর পণ্য গত অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৩২২ কোটি ডলারের। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছে ২৫৫ কোটি ডলারের। আমদানি কমেছে ২৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। একই সময়ে গত অর্থবছরে এলসি খোলা হয়েছিল ৩৩২ কোটি ডলারের। চলতি অর্থবছরে এলসি খোলা হয়েছে ২৩১ কোটি ডলারের। এলসি খোলা কমেছে ৪৩ দশমিক ৭২ শতাংশ।
এদিকে ব্যাংকগুলো এখন ডলারের সংস্থান না করে এলসি খুলতে পারছে না। যে কারণে এলসি খোলা আরও কমেছে। এলসির বিপরীতে ডলার থাকতে হবে বা এলসি দেনা শোধের সময় ডলার মিলবে- এমন কোনো নিশ্চিত সংস্থান থাকতে হবে। আমদানির চাহিদার তুলনায় ডলারের প্রবাহ বাজারে কম বলে ব্যাংকগুলো এলসির বিপরীতে আগাম ডলারের সংস্থান করতে পারছে না। যে কারণে এলসিও খুলতে পারছে না।
আমদানি ও এলসি খোলার প্রাপ্ত বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, গত এক বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে দুয়েকটি ছাড়া অনেক পণ্যের দামই কমেছে। যে কারণে ডলারের হিসাবে এলসি কমলেও দাম কমায় পণ্যের আমদানি বেড়েছে বেশি। আগে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেশি হওয়ায় ডলারের হিসাবে এলসি খোলা হার বেড়েছিল। তাদের মতে, আসন্ন রোজায় বাজারে নিত্যপণ্যের কোনো সংকট হবে না।
এবার মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে রোজা শুরু হচ্ছে। ওই সময়ে রোজানির্ভর বেশির ভাগ দেশি পণ্যের জোগান থাকবে বাজারে। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত মসলাজাতীয় পণ্য পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ বাজারে চলে এসেছে। ফলে রোজায় এগুলোর কোনো সংকট হবে না। এসব পণ্যের আমদানি কমাতে সমস্যা নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে পেঁয়াজের এলসি বেড়েছে ১১২ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং আমদানি বেড়েছে ১০৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এর কারণ হিসাবে জানা যায়, ভারতে পেঁয়াজের দাম বাড়ায় এলসি খোলা বেড়েছে। গত বছরের ওই সময়ে ভারতে পেঁয়াজের দাম কম ছিল। আগে তুরস্ক ও মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ এলেও এখন ডলার সংকটের কারণে ওইসব দেশ থেকে আমদানির এলসি খোলা যাচ্ছে না।
একই সময়ের ব্যবধানে মসলাজাতীয় পণ্যের আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে ৯২ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং আমদানি বেড়েছে ৮৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। শীতে মসলার চাহিদা বাড়ে। এ কারণে শীতের আগেই আন্তর্জাতিক বাজারে মসলার দাম বেড়েছে।
গত বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৪০ সেন্ট, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫৭ সেন্ট। ওই সময়ে এর দাম বেড়েছে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ। যে কারণে চিনি আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে ২৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং আমদানি বেড়েছে ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। রোজায় এর চাহিদা বেশি থাকে। ফলে আমদানিও বেশি হয়েছে।
রোজায় সয়াবিন তেলের চাহিদা বেশি থাকে। কিন্তু আমদানি কমেছে। তবে গত এক বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম কমেছে ২৭ দশমিক ৯১ শতাংশ। গত বছরের নভেম্বরে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের প্রতি টনের দাম ছিল ১ হাজার ৫৬০ ডলার। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১২৫ ডলারে। একই সময়ে পাম অয়েলের প্রতি টনের দাম ৯৯৭ ডলার থেকে কমে ৮৫৬ ডলারে নেমেছে। আলোচ্য সময়ে দাম কমেছে ১৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। যে কারণে এলসি ও আমদানি কমেছে ডলারের হিসাবে। তবে বাজারে চাহিদা অনুযায়ী আমদানি ও সরবরাহ স্বাভাবিক। গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে পরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি এলসি খোলা কমেছে ৪৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ৫১ শতাংশ। এদিকে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানির এলসি কমেছে ৮৪ দশমিক ২৫ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ৬১ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
তবে অনেক উদ্যোক্তাই বলেছেন, ডলার সংকটের কারণে তারা চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পারছেন না। কেবল যাদের বিভিন্ন উৎস থেকে ডলার সংস্থানের সুযোগ রয়েছে, তারাই কেবল এখন এলসি খুলতে পারছেন। দেশে উৎপাদিত দুধ ও দুগদ্ধজাতীয় পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে আমদানির চাহিদা কমেছে। তারপরও এসব পণ্য আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে ১ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং আমদানি বেড়েছে ৭ দশমিক ২১ শতাংশ।
রোজায় বিভিন্ন ধরনের ফলের চাহিদা থাকে বেশি। এবার দেশি ফলের মধ্যে বড়ই, কমলা, পেয়ারা, বারোমাসি তরমুজ, ডালিম, কলার সরবরাহ থাকবে। তারপরও আমদানি ফলের চাহিদাও রয়েছে। এর মধ্যে খেজুরের চাহিদা বেশি। খুজুরের আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে। এছাড়া সার্বিকভাবে ফলের এলসি খোলা বেড়েছে ২৯ দশমিক ২০ শতাংশ। তবে আগে এলসি খোলা কমায় এখন আমদানি কমেছে ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। নতুন এলসির ফল দেশে আসা শুরু করলে আমদানি বেড়ে যাবে।
রোজায় ডাল ও ছোলার চাহিদা থাকে বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে এগুলোর দামও কমেছে। এ কারণে আমদানির এলসি কমেছে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ১৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ডলার ও ছোলার বড় অংশই আমদানিনির্ভর। দেশে উৎপাদন হয় খুবই কম। ডলার সংকটে তারা এলসি খুলতে পারছেন না।
আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কিছুটা কমার পর এখন আবার বাড়ছে। চালের প্রতি টনের দাম গত বছরের নভেম্বরে ছিল ৪৩০ ডলার। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০২ ডলারে। আলোচ্য সময়ে এর দাম বেড়েছে ৩৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। একই সময়ে গমের দাম ৩১৭ ডলার থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২৩৭ ডলার। আলোচ্য সময়ে দাম কমেছে ২৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে চাল ও গম আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৪৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ২৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। দেশে চালের বাম্পার ফলন হয়েছে বলে এর আমদানি কমেছে। এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমায় গমের আমদানি কমেছে ডলারের হিসাবে, তবে পরিমাণে বেড়েছে।