ডাকসু ভবনে হামলায় ভিপি নুরসহ আহত ১৫

Untitled-1-5dff35bb9af03

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবনে ভিপি নুরুল হক নুরের অফিসে হামলা চালিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

রোববার দুপুর পৌনে ১টার দিকের এ ঘটনায় ভিপি নুরুল হক নুরসহ বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন।

আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া হামলার সময় ভিপির কক্ষের কম্পিউটার, চেয়ারসহ আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর ১২টার দিকে রাজু ভাষ্কর্যে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ তাদের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি শেষ করে ডাকসু ভবনের দিকে মিছিল নিয়ে যায়। একপর্যায়ে সেখানে ভিপি নুরসহ তার অনুসারীদের সঙ্গে মঞ্চের নেতাকর্মীদের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। পরে মঞ্চের কিছু নেতাকর্মী নুরদের উদ্দেশে ডাকসু ভবনের দিকে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। মঞ্চের কিছু নেতাকর্মী ডাকসু ভবনের দ্বিতীয় তলায় ওপরে উঠতে থাকলে নুরের অনুসারীরা তাদের প্রতিহত করে ডাকসু ভবনের মূল ফটক বন্ধ করে দেন।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস এবং সাধারণ সম্পাদক ও  ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন ডাকসু ভবনের মূল ফটক খুলে ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় তাদের সঙ্গে ছাত্রলীগের কিছু অনুসারীও ঢুকে পড়েন ডাকসুতে। সনজিত-সাদ্দাম ভিপি নুরের কক্ষে গিয়ে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিরাগতদের বের করে দেয়ার নির্দেশনা দেন। কিন্তু এতে ভিপি আপত্তি জানালে উভয়ের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।

এ সময় ছাত্রলীগের অন্য নেতাকর্মীরা ভিপি নুরের কক্ষে থাকা তার সংগঠন ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের’ নেতাকর্মীদের এক এক করে কক্ষ থেকে বের করে দেন। কক্ষ থেকে বের করে সিঁড়িতে অবস্থান নেওয়া ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীরা তখন তাদের লাঠিপেটা করেন।

এক পর্যায়ে সনজিত ও সাদ্দাম ভিপির কক্ষ থেকে বের হয়ে মধুর ক্যান্টিনের দিকে চলে যান। তারা চলে যাওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা লাঠিসোঠা নিয়ে নুরের অফিস কক্ষে ঢুকে লাইট বন্ধ করে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। এতে নুরসহ আহত হন পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন, যুগ্ম-আহ্বায়ক ফারুক হোসেন, রাশেদ খানসহ সংগঠনটির ১৫ নেতাকর্মী। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের সহায়তায় তাদের বের করে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

হামলার পর ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রুশাদ ফরিদী। ঘটনার বিষয়ে নিজের ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, ‘শিক্ষকতা ছেড়ে দেয়ার সময় হয়েছে। চোখের সামনে ডাকসু ভিপি নুর আর অন্যান্য ছাত্রদের মেরে শেষ করে ফেলা হল। কিছুই করতে পারলাম না। নিজেদের ছাত্রদের রক্ষা করতে পারি না এই শিক্ষকতার কি দাম আছে? এইটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়? আর আমিও একজন শিক্ষক?’
( হামলায় আহত একজনকে নেওয়া হচ্ছে হাসপাতালে )

তবে হামলায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আল মামুন। তিনি বলেন, ‘ভিপি নুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত ক্যাডারদের নিয়ে এসে ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছিল। তাই সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই খবর শুনে তা প্রতিহত করতে যায়। এখানে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কোন সম্পৃক্ততা নেই।’

মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কোন নেতাকর্মী উপস্থিত ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় তারা সাধারণ শিক্ষার্থী।’

ঘটনার পর সাদ্দাম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা চাইনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের অনাকাঙিক্ষত ঘটনা ঘটুক। গত কয়েকদিন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও নুরের সঙ্গে শিবির সংশ্লিষ্টদের ধারাবাহিক সংঘর্ষের ঘটনা দেখছি। আজকেও ঐতিহ্যবাহী মধুর ক্যান্টিন ও ডাকসু ভবনে দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান করেছিল। আমরা নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছি। আমরা দুই পক্ষকেই আহ্বান জানাই তারা যেন নিজেদের ভেতরের সমস্যা সমাধান করে নেয়।’ হামলায় ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেন তিনি।

ঘটনার পর ছাত্রলীগের সনজিতকে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।পরে নিজের ফেসবুক ওয়ালে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি। যেখানে তিনি কয়েকজনের ছবি দিয়ে লেখেন, ‘বহিরাগত শিবির ক্যাডারদের নিয়ে ক্যাম্পাসে হামলা ও অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিলো পাগলা নূরা, সচেতন শিক্ষার্থী ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ স্বাধীনতা বিরোধীদের সমুচিত জবাব দিয়েছে, এই ক্যাম্পাসে কোন স্বাধীনতা বিরোধীদের জায়গা হবে না। নুরুর নাটক সবাই বুঝে গেছে।’

হামলার বিষয়ে নুরের প্যানেল থেকে নির্বাচিত ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন বলেন, ‘ছাত্রলীগের নেতৃত্বে প্রশাসনের প্রশ্রয়ে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর, ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন, যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান, ফারুক হোসেন, মশিউর রহমানসহ অন্তত ৪০ জনের ওপর হামলা হয়েছে। কারও পা ভেঙ্গে গেছে, নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে, বমি করছে, বুকের হাড় ভেঙ্গে গেছে। অনেকে আইসিইউতে রয়েছে। অনেকের অবস্থা সংকটাপন্ন। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরা নিয়ে আমরা আশঙ্কা করছি।’

এদিকে ঘটনার পর ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানী সাংবাদিকদের বলেন, ‘নুর নিজের দুর্নীতি ঢাকতে বহিরাগতদের নিয়ে ডাকসুকে ব্যবহার করে অরাজকতা করছেন। সে সকাল থেকে বহিরাগতদের দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ডাকসুতে আশ্রয় দিয়ে রেখেছেন।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘নুরসহ আহতদের ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে পাঠিয়েছি। সেখানে সহকারী প্রক্টররা আছেন। আগে চিকিৎসা হোক, পরে সবার বক্তব্য শুনে তারপর ব্যবস্থা নিব।’

এদিকে নুরের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিকেলে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট, সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, ইশা ছাত্র আন্দোলন। হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে ছাত্র ফেডারেশন।

ভিপি নুরের ওপর হামলার নিন্দা ড. কামালের

ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। একইসঙ্গে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন তিনি।

বুধবার এক বিবৃতিতে ড. কামাল বলেন, ভারতের নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসির বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে চলমান আন্দোলন ও জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ওপর সে দেশের পুলিশের হামলার প্রতিবাদে ডাকসু ভিপি নুরের আহূত সংহতি ও প্রতিবাদ সমাবেশে ছাত্রলীগের হামলায় নুরসহ কয়েকজন ছাত্র আহত হন। এ ধরনের হামলা অবিবেচকের কাজ।

অপর এক বিবৃতিতে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, এই দেশে আজ কেউ নিরাপদ নন। বাকস্বাধীনতা বলতে দেশে কিছু নেই। কেউ সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বললেই তার কণ্ঠরোধের চেষ্টা করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ভিপি নুরের ওপর হামলা চালিয়ে তার দুই আঙুল ভেঙে দিয়েছে ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানান রেজা কিবরিয়া।

ভিপি নুরের ওপর হামলায় বাম জোটসহ বিভিন্ন সংগঠনের নিন্দা

 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হক নুরসহ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বামপন্থি বিভিন্ন জোট, দল ও সংগঠন।

রোববার পৃথক সভা-সমাবেশ ও বিবৃতিতে এসব সংগঠনের নেতারা এ হামলায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও বিচারের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছেন।

রাজধানীর পুরানা পল্টনের সিপিবি কার্যালয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সভার প্রস্তাবে বলা হয়, ছাত্রলীগ নেতা ও ডাকসু এজিএস সাদ্দাম হোসাইনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা এবং ‘মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ’ নামের গুণ্ডাবাহিনী ডাকসু ভবনে ভিপি নুরসহ শিক্ষার্থীদের ওপর যেভাবে হামলা চালিয়েছে, তা নজিরবিহীন। অবিলম্বে এই হামলাকারী সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক আবদুল্লাহ আল ক্বাফী রতনের সভাপতিত্বে সভায় অংশ নেন জোটের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ শাহ আলম, সাইফুল হক, বজলুর রশীদ ফিরোজ, অধ্যাপক আবদুস সাত্তার, সাজ্জাদ জহির চন্দন, খালেকুজ্জামান লিপন, ফখরুদ্দিন কবির আতিক, হামিদুল হক, মনির উদ্দিন পাপ্পু, শহিদুল ইসলাম সবুজ, লিয়াকত আলী প্রমুখ।

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান এক বিবৃতিতে বলেন, ‘দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ছাত্রদের নির্বাচিত প্রতিনিধির ওপর তার কার্যালয়ে হামলা করার যে ধৃষ্টতা সন্ত্রাসীরা দেখিয়েছে- তা দেশে স্বৈরাচারী ব্যবস্থার অন্যতম দৃষ্টান্ত। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, সেটিও দুঃখজনক ও নিন্দনীয়।

বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক পৃথক বিবৃতিতে বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের’ চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা ডাকসু ভিপি ও তার সহকর্মীদের ওপর হামলা-আক্রমণ চালিয়ে আসছে। নির্বাচিত ভিপির বিরুদ্ধে এ ধরনের হামলা-আক্রমণের দায় সরকার ও সরকারি দলকেই নিতে হবে।

জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বিবৃতিতে বলেন, জনগণের মতপ্রকাশ ও সভা-সংগঠন করার স্বাধীনতা কেড়ে নিতে সরকার এখন বিরোধী ছাত্র নেতৃত্বকে টার্গেট করেছে।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (বিসিএল) সভাপতি শাহজাহান আলী সাজু ও সাধারণ সম্পাদক গৌতম শীল বিবৃতিতে বলেন, এ হামলা ছাত্র রাজনীতির জন্য অশুভ সংকেত। এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজকে সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

Pin It