গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে বয়স্কদের পাশাপাশি শিশুরাও নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে শিশুরা ডায়রিয়া, বমি, নিউমোনিয়া, সর্দিজ্বরের মতো মৌসুমি রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। রাজধানীর একাধিক হাসপাতাল ঘুরে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও রোগীর অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশে (আইসিডিডিআর,বি) ৬০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডায়রিয়া রোগী ভর্তি (দৈনিক হিসাবে) হয়েছেন এ বছর।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের নিচতলার সাত নম্বর রেফারেল ওয়ার্ডের ১৪নং বিছানায় রোববার থেকে ভর্তি রয়েছে ১৬ মাস বয়সি রায়হান। শিশুটির বাবা মাহবুব লস্কর জানান, তীব্র গরমে ১৮ মার্চ দুপুরে হঠাৎ বমি করতে থাকে শিশুটি। সন্ধ?্যায় পাতলা পায়খানা শুরু হয়। নিকটস্থ ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাওয়ালেও কিছুতেই সুস্থ হচ্ছিল না। পরে মহাখালীর ইউনিভার্সেল হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসকরা টানা পাঁচটি স্যালাইন পুশ করেন ছেলের শরীরে। সেখানে আট ঘণ্টা চিকিৎসাধীন থেকে আট হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। ব্যয় বেশি হওয়ায় পরদিন সকাল দশটায় মহাখালীর আইসিডিআরবি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেও চার ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। তবে চিকিৎসকরা জিংক ট্যাবলেট ও মুখে খাওয়ার ওষুধ দিয়ে অবজারবেশনে রেখে রিলিজ দিয়ে দেন।
শিশুটির মা লিপি খাতুন বলেন, হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে এলে তার পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। প্রস্রাব বন্ধ হওয়াসহ গা-হাত-পা ফুলে যায়। এরপর রোববার সকালে শিশু হাসপাতালে এসে সারাদিন অপেক্ষার পর এক চিকিৎসকের সহায়তায় ছেলেকে ভর্তি করি। ও এখন অনেকটা সুস্থ।
রেফালের ওয়ার্ডের দায়িত্বরত কয়েকজন নার্স জানান, এই ওয়ার্ডের ৩০টা বিছানার মধ্যে বিশটি বিছানায় সিজনাল রোগ ঠান্ডা, জ্বর, নিউমোনিয়া, বমি, ও ডায়রিয়া নিয়ে রোগীরা ভর্তি রয়েছে।
শিশু হাসপাতালের চারতলার ১৫নং ওয়ার্ডের পাশে আরেক শিশুকে নেবুলাইজারের মাধ্যমে শ্বাসপ্রশাস নিতে দেখা যায়। শিশুটির বাবা আব্দুল্লাহ বলেন, হঠাৎ গরমে ছেলের শরীরে অতিরিক্ত ঘাম হচ্ছিল। কিন্তু বাড়িতে ফ্যান চালালে সর্দির সমস্যা হয়। আর অতিরিক্ত গরম ও সর্দির কারণে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। ফলে হাসপাতালে ভর্তির পর থেকেই অক্সিজেন দিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যেসব রোগ দেখা দেয় তাতে বেশি আক্রান্ত হয় শিশুরা। দ্বিতীয় পর্যায়ে আক্রান্ত হয় বয়স্করা। এবার দেশজুড়ে গ্রীষ্মের অতিরিক্ত গরমে বড়দের পাশাপাশি শিশুরা তুলনামূলক কম আক্রান্ত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১০ জন শিশু ডায়ারিয়া নিয়ে এখানে ভর্তি হয়েছে। এই মুহূর্তে হাসপাতালে ভর্তি ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা প্রায় একশ জনের মতো।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের শিশু বহির্বিভাগের চিকিৎসকরা জানান, করোনা পরিস্থিতি কমার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রায় তিন মাসের বেশি সময় ধরে বৃষ্টি না থাকা ও নগরায়ণের ফলে ধুলাবালির পরিমাণ বাড়ছে। এরই মধ্যে অতিরিক্ত গরমে বিদ্যালয়গামী শিশুদের বাইরে যেতে হচ্ছে। তারা রাস্তার পাশের খাবারের দোকানগুলো থেকে অপরিশোধিত পানি ও ভাজাপোড়া খাদ্য গ্রহণ করছে। এতে বড়দের মতো শিশু-কিশোররা ফুড পয়জনিং ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। চিকিৎসার জন্য প্রতিদিন সোহরওয়ার্দী হাসপাতালের ইনডোর ও আউটডোরে এসব রোগী আসছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের চিকিৎসক ডা. রোমানা বলেন, ঋতু পরিবর্তনের কারণে এমনিতে বিভিন্ন ধরনের রোগের প্রকোপ বাড়ে। প্রকৃতিতে এখন গরম বেড়ে গেছে, তাই সতর্ক হতে হবে। বাইরের খোলা খাবার থেকে বিরত থাকতে হবে। পানি ভালো করে ফুটিয়ে খেতে হবে। বাচ্চাদের গোসলের সময় পানি যাতে না খায় এটি দেখতে হবে।
৬০ বছরের মধ্যে আইসিডিডিআর,বিতে সর্বোচ্চ ডায়রিয়া রোগী : রাজধানীর মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশে (আইসিডিডিআর,বি) ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর উপচেপড়া ভিড়। গত কয়েকদিন ধরে এ হাসপাতালে দৈনিক ১২শ’র বেশি রোগী ভর্তি হন। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটির ৬০ বছরের মধ্যে একদিনে এত বেশি ডায়রিয়া রোগী একসঙ্গে ভর্তির ঘটনা এটিই প্রথম। এর আগের দুই বছর দৈনিক রোগী ভর্তির সংখ্যা অনেক কম ছিল। ২০১৮ দৈনিক গড়ে ১ হাজারে মতো রোগী ভর্তি হয়েছিল। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি ছিল ১ হাজার ৪৭ জন। এর আগে ২০০৭ সালে বন্যার সময় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, সে সময়ও দৈনিক রোগী ভর্তি সংখ্যা ছিল এক হাজারের মধ্যে।
আইসিডিডিআর.বি সংশ্লিষ্টরা আরও জানিয়েছে, ১৬ মার্চ ১ হাজার ৫৭ জন ডায়রিয়া রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। পরদিন তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৪১ জনে। ২০ মার্চ রোগীর সংখ্যা হয় ১ হাজার ১৫৭ জন, ২১ মার্চ ১ হাজার ২১৬ জন, ২২ মার্চ ১ হাজার ২৭২ ও ২৩ মার্চ ১ হাজার ২৩৩ জন। এ হাসপাতালে রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলোসহ ঢাকার রোগীরা বেশি ভর্তি হচ্ছে। যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, কদমতলী, দক্ষিণখানের রোগীর সংখ্যা বেশি। মোহাম্মদপুর ও মিরপুর থেকেও কিছু রোগী ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালটিতে। ভর্তি রোগীদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ও পুরুষ রোগীর সংখ্যাই বেশি। শয্যার চেয়ে রোগী বেশি হওয়ায় তাঁবু টানিয়ে ডায়রিয়া রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছে আইসিডিডিআর,বি। শয্যা আরও বাড়িয়ে আজ থেকে দ্বিতীয় তাঁবু তৈরি করে সেবাদানের প্রস্তুতি নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।