শরিফুল ইসলাম ছিলেন একটি চেইন শপের বিক্রয়কর্মী। এই পরিচয়ের আড়ালে অভিনব প্রতারণায় যুক্ত ছিলেন তিনি। তার হাতে থাকত ডিজিটাল ঘড়ি। মূলত ওই ঘড়িতে সংযুক্ত ছিল বিশেষ স্ক্যানিং ডিভাইস, যার মাধ্যমে তিনি গ্রাহকদের এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করতেন। এর পর বাসায় গিয়ে সেগুলো কাজে লাগিয়ে ক্লোন এটিএম কার্ড বানাতেন তিনি। পরচুলা ও রোদ চশমা পরে শরিফুল সেই ক্লোন কার্ডের মাধ্যমে টাকা তুলতেন। এভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন বিভিন্ন গ্রাহকের কোটি টাকার বেশি। শরিফুলকে গ্রেফতারের পর মানি লল্ডারিং আইনে মামলা করে পুলিশ। শুধু শরিফুলের এ ঘটনা নয়; গত কয়েক বছরে ঢাকায় নতুন ধরনের অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাবোধের অভাবও। অপরাধীদের নানামুখী তৎপরতার শিকার হচ্ছেন রাজধানীর বহু মানুষ। বাসা থেকে বের হয়ে যানজটের ঝক্কি, দুর্ঘটনার আতঙ্কের পাশাপাশি অপরাধীদের পেতে রাখা ফাঁদ এড়িয়ে নির্বিঘ্নে বাসায় ফেরাটাই এখন বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে কখন কীভাবে অজানা বিপদে জালে আটকা পড়বেন- ঘুণাক্ষরেও তা টের পাওয়ার উপায় নেই। এমন পরিস্থিতি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশের জন্যও নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে দেশি-বিদেশি কিছু সংঘবদ্ধ চক্র নানা কৌশলে প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে সাধারণ মানুষকে। সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত অপরাধের ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৮ সালে দেশে সাইবার অপরাধের মোট ঘটনার ৩১ দশমিক ৫৬ শতাংশের ঘটনাস্থল ঢাকা। ২০১৭ সালের তুলনায় গত বছর ঢাকায় ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। বেড়েছে চুরির ঘটনা। তবে ঢাকায় খুনোখুনির ঘটনা এ সময়ে কিছুটা কম হয়েছে।
আজ বুধবার ডিএমপির ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ২ কোটির বেশি মানুষ এ মহানগরীতে বাস করছেন। তাদের নিরাপদ জীবনযাপনের পথে নানা সময় দেখা দেয় প্রতিবন্ধকতা। যেন পদে পদে ওঁৎ পেতে থাকে বিপদ। দেশীয় ও বৈশ্বিক বাস্তবতায় আন্তঃমহাদেশীয় অপরাধ ও সাইবার ক্রাইম ঠেকানোকেই আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা। তাদের মতে, শুধু পুলিশের সংখ্যা বাড়িয়ে নয়; অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। তাহলে পুরোপুরি অপরাধ নির্মূল করা না গেলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী সমকালকে বলেন, ঢাকাকে নিরাপদ ও বাসযোগ্য করার জন্য নিজ নিজ ক্ষেত্রে সবারই জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধমুক্ত ও নারীবান্ধব ঢাকা গড়ে তুলতে পুলিশের ভূমিকাই মুখ্য।
প্রায় প্রতিদিনই সাইবার মামলা :উন্নত বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশের সাইবার অপরাধের ধরন কিছুটা ভিন্ন। ঢাকায় সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে পারিবারিক বিদ্বেষ, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, অন্তরঙ্গ ভিডিও ও ছবি আপলোড, ভুয়া একাউন্ট পেজ তৈরি, ফেসবুক আইডি হ্যাকিংয়ের ঘটনাই বেশি। এ ছাড়া পর্নোগ্রাফি, ই-কমার্স প্রতারণা বা জালিয়াতি, মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট প্রতারণা ও ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড সংক্রান্ত প্রতারণা, অনলাইন এমএলএম, অনলাইন গ্যাম্বলিং, টেররিস্ট ফাইন্যান্সিং ও অনলাইনে জঙ্গি কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করার মতো ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। ডিএমপির পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী, ২০১৮ সালে রাজধানী ছাড়া দেশের অন্যান্য এলাকায় প্রচলিত সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আইনে ১ হাজার ৫৫টি মামলা হয়েছে। একই বছর ঢাকায় এ সংক্রান্ত মামলা হয় ৩৩৩টি। ২০১৭ সালে এ সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ২৩৬টি। বাকি এলাকায় মামলার সংখ্যা ১ হাজার ২৮টি। ২০১৬ সালে ঢাকায় এ আইনে মামলা হয় ২০৬টি। আর ঢাকা বাদে দেশের অন্যান্য এলাকায় মামলা হয়েছে ৮৭৯টি। সাইবার অপরাধের যারা শিকার তাদের মধ্যে ৩৪ শতাংশের বয়স ১৯ থেকে ২৫ বছর; ৩১ শতাংশের বয়স ২৬ থেকে ৩৫ বছর; ২৭ শতাংশের বয়স ৩৬ থেকে ৫৫ বছর; ২ শতাংশের বয়স ৫৫ বছরের বেশি। ৬ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে, আইনে যাদের শিশু হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ডিএমপির গবেষণায় উঠে এসেছে, সাইবার অপরাধের শিকার ৫৩ শতাংশ নারী। এ ছাড়া গত বছর প্রশ্নপত্র ফাঁস, পাবলিক পরীক্ষায় জালিয়াতি, সাইবার জগতে উগ্র মতাদর্শ প্রচার, মোবাইল ফিন্যান্স প্রতারণার সঙ্গে জড়িত ১৮৬ জনকে গ্রেফতার করে সাইবার সিকিউরিটি ও অপরাধ বিভাগ।
ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের ডিসি আলিমুজ্জামান বলেন, নতুন নতুন অপরাধ ঘটছে। তবে সেগুলো প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পুলিশ প্রস্তুত।
বেড়েছে ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতন :সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় নারী ও শিশু নির্যাতনের বেশ কিছু ঘটনা মানুষের তীব্রভাবে আলোড়িত করেছে। গত ৫ জানুয়ারি ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় আয়েশা নামে ২ বছরের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। শিশুটির পরিবারের অভিযোগ, নাহিদ (৪৫) নামে এক প্রতিবেশী ২ বছরের ওই শিশুকে খিচুড়ি খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে নিজের বাসায় ডেকে নেয়। পরে শিশুটিকে ‘ধর্ষণের’ পর তিন তলার বারান্দা থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করে। ৭ জানুয়ারি ডেমরা এলাকার একটি ঘরের খাটের নিচ থেকে ফারিয়া আক্তার দোলা (৫) ও নুসরাত (৪) নামে দুই শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় মোস্তফা ও তার মামাতো ভাই আজিজুলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে জবানবন্দিতে তারা স্বীকার করে শিশু দুটিকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার কথা। একই দিন ঢাকার তুরাগ এলাকায় স্কুল থেকে ফেরার পথে ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যার চেষ্টা করে এক যুবক। প্রাণে রক্ষা পেলেও ১১ বছর বয়সী ওই শিশুটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে চিকিৎসাধীন। ঢাকা মহানগর পুলিশের পরিসংখ্যানে রয়েছে, ২০১৮ সালে ঢাকায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৭৮টি; ২০১৭ সালে ৩৭৫টি ও ২০১৬ সালে ৩২৫টি। ২০১৮ সালে ঢাকায় শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২৮৮টি; ২০১৭ সালে ২৬৮টি ও ২০১৬ সালে ১৮০টি। ২০১৮ সালে ডিএমপির উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট ৩৫২টি মামলার নিষ্পত্তি করেছে। বর্তমানে তদন্তাধীন মামলা আছে ৬০টি।
খুন কমেছে, বেড়েছে চুরি :এদিকে ২০১৮ সালে রাজধানীতে হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২১৬টি। ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ছিল ২১৮টি এবং ২০১৬ সালে ১৩২টি। চুরি সংক্রান্ত ঘটনায় দায়ের করা মামলার সংখ্যা ঢাকায় বেড়েছে। ২০১৮ সালে রাজধানীতে চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ২৮৯টি; ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৯৭ ও ২০১৬ সালে ১ হাজার ৫৪৪। তবে একাধিক ভুক্তভোগী ও সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকৃতভাবে ঢাকায় চুরি-ছিনতাইয়ের যে সংখ্যক ঘটনা ঘটে, তার তুলনায় মামলার সংখ্যা অনেক কম। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ দেখাতে অনেক সময় চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও ‘হারানোর’ জিডি নিয়ে দায়সারাভাবে কাজ সারার চেষ্টা করেন মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা। সম্প্রতি রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় বিদেশ ফেরত এক নারীর ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ওই ব্যাগে মোবাইল, টাকাসহ অন্যান্য জিনিস ছিল। থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ চুরির জিডি করে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে যায়।
মাদকের মামলা বেড়েছে, কমেছে ইয়াবা উদ্ধার :ডিএমপির পরিসংখ্যান বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, ঢাকায় মাদক উদ্ধারজনিত মামলার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৮ সালে মাদক আইনে মামলা হয়েছে ১৬ হাজার ২১৫টি; ২০১৭ সালে ১৩ হাজার ৬৩৮টি ও ২০১৬ সালে ৯ হাজার ৬২৮টি। ২০১৭ সালে ডিএমপি ২৮ লাখ ৯৮ হাজার ৩৯৭ পিস ইয়াবা জব্দ করে। ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ছিল ৬১ লাখ ৬৪ হাজার ৮৩০টি। ২০১৮ সালে মাদক সংক্রান্ত ঘটনায় আসামি গ্রেফতার করা হয়েছে ২৫ হাজার ৮০৪ জন। বর্তমানে বিভিন্ন ইউনিটে তদন্তাধীন মামলা রয়েছে ৭৩৮টি। ২০১৮ সালে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের ১৪ হাজার ৫৩১টি মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়।
৬১ লাখ নাগরিকের তথ্যভাণ্ডার :উন্নত বিশ্বের নাগরিক তথ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থার আদলে ঢাকা মহানগরী এলাকায় বসবাসরতদের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালনা করছে পুলিশ। সিটিজেন ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিআইএমএস) সফটওয়্যারে এখন পর্যন্ত ৬০ লাখ ৯২ হাজার ৯২৭ জনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সংশ্নিষ্টরা বলছে, তথ্য দেওয়া ছাড়া বাড়ি ভাড়া পাওয়া কঠিন হওয়ায় সন্ত্রাসী, জঙ্গি ও অন্যান্য অপরাধমূলক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়েছে। ১৯৭৬ সালে ১২টি থানা নিয়ে গঠিত ডিএমপির বর্তমান জনবল ৩০ হাজার ৫৪৫ জন; থানার সংখ্যা ৫০টি।