এ যেন রীতিমতো রূপকথার গল্প। ডি ভিলিয়ার্স-হেলসের ১৮৫ রানের অসাধারণ এক জুটিতে ঢাকা ডায়নামাইটসকে ৮ উইকেটে হেসেখেলে হারিয়েছে রংপুর রাইডাস। ডি ভিলিয়ার্স অপরাজিত ছিলেন সেঞ্চুরি করে, হেলস ৮৫।
শতভাগ ক্রিকেটীয় শট। একেবারে মাঝ ব্যাটে লাগিয়ে। নেই বাড়তি কোনো কিছু করার চেষ্টা। একেবারে হিসেব কষে, প্রতিটি বোলারকে আপাদমস্তক পড়ে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে কী অসাধারণ এক সেঞ্চুরিই না করলেন এবি ডি ভিলিয়ার্স। দক্ষিণ আফ্রিকা তারকার ৫০ বলে ১০০ রানের ইনিংসেই বিপিএলের আগুন লড়াই শেষ। ঢাকা ডায়নামাইটসের ১৮৬ রানের ইনিংসকে টপকে রংপুর রাইডার্স পেয়ে গেল ৮ উইকেটের এক দারুণ জয়।
সেঞ্চুরি করেননি বলেই হয়তো ইংলিশ তারকা অ্যালেক্স হেলস একটু পেছনে পড়ে গেলেন। সেটি পেতে পারতেন যদি না ভিলিয়ার্সের জন্য ত্যাগ স্বীকারটা না করতেন। ভিলিয়ার্স একটু এগিয়ে ছিলেন দেখে ছেড়ে দিয়েছেন সিংহাসন। কিন্তু তিনিও কী কম যান! ৫৩ বলে ৮৫ রানের অসম্ভব দৃষ্টি সুখকর এক ইনিংস খেলেছেন। সেখানেও নেই তাড়াহুড়ো, নেই কোনো অক্রিকেটীয় কিছু। পুরোপুরি ক্রিকেট ব্যাকরণ মেনে এবি ডি ভিলিয়ার্সের সঙ্গে ১৮৫ রানের জুটির সঙ্গী তিনি। চট্টগ্রামের দর্শকেরা তো বটেই, আজকের ম্যাচটি যারা টেলিভিশনে চোখ লাগিয়ে দেখেছেন, তারা নিজেদের ভাগ্যবান ভাবতেই পারেন। বিপিএলকে বড় একটা ধন্যবাদ দিতে পারেন, এমন অসাধারণ দুটি ইনিংস আর চমৎকার ম্যাচজয়ী একটি জুটি উপভোগের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
অথচ, কী বাজে সময়েই না জুটিবদ্ধ হয়েছিলেন এই দুই তারকা। সামনে ১৮৭ রানের লক্ষ্য, স্কোরবোর্ড মাত্র ৫ রান উঠতেই ফিরে গেছেন ক্রিস গেইল আর এবারের বিপিএলে আজকের আগ পর্যন্ত রংপুর রাইডার্সের সেরা পারফরমার রাইলি রুশো। প্রোটিয়া রুশোর বিদায়ে ঢাকা তখন জয়ের নেশায় উদ্বেল। তবে প্রত্যাশা ছিল ডি ভিলিয়ার্স আর হেলসের ওপর। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণের চিত্রনাট্য যে এত চমৎকার হবে, সেটি হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেননি।
শাহাদতের প্রথম ওভারে এসেছিল মাত্র ৪ রান। গেইল ব্যাটেই বল লাগাতে পারছিলেন না। রাসেলের দ্বিতীয় ওভারে ৭। কিন্তু রাসেলের বলে প্রথমে গেইল আর পরে রুশো আউট। গেইলকে ক্যারিবীয় সতীর্থ সুনীল নারাইনের ক্যাচে পরিণত করলেন তিনি। আর ডিআরএসের কল্যাণে আউট রুশো। তাঁর বিপক্ষে কট বিহাইন্ডের আবেদনটা প্রথমে নাকচই করে দিয়েছিলেন আম্পায়ার। পরে রিভিউ নিয়ে দেখা গেল বলটি সত্যি সত্যিই রুশোর গ্লাভস ছুঁয়ে উইকেটরক্ষক নুরুল হাসানের কাছে গেছে।
৫ রানে ২ উইকেট হারিয়ে ফেলা অবস্থায় এবি ডি ভিলিয়ার্স আর হেলস শুরু করলেন হিসেবী ব্যাটিং। তৃতীয় ওভারেই পাল্টা আক্রমণে হেলস আর ভিলিয়ার্স বুঝিয়ে দিলেন ২ উইকেট পড়ে গেছে তো কী হয়েছে! সাকিব আল হাসানের সেই ওভারটিতে এল ১৫! হেলস মারলেন একটি বাউন্ডারি ও একটি ছক্কা। ভিলিয়ার্স চার। রাসেলের চতুর্থ ওভারেই আবার ১৫! ভিলিয়ার্স একাই মারলেন তিনটি চারের মার। নারাইন করতে আসলেন পঞ্চম ওভার। এবার হেলসের দুটি বাউন্ডারি আর ভিলিয়ার্সের একটি। এই তিনটি ওভারেই ৪৪ রান তুলে রান তাড়ার তাগড়া ঘোড়াটিকে পুরোপুরি বশে নিয়ে এলেস এ দুজন। এরপর থেকে দুজন কষে গেলেন রীতিমতো অঙ্ক। খুব বেশি রান পরের ওভারগুলিতে এল না। কিন্তু নিয়ন্ত্রণটা কখনোই ঢাকার হাতে চলে গেল না। সাকিবের দ্বিতীয় ওভারেও এল ১১। তবে রুবেল হোসেন কিছুটা নিয়ন্ত্রিত বোলিং করে আশা জাগিয়েছিলেন। নারাইনও খারাপ করছিলেন না। লক্ষণীয় দিক ছিল একমাত্র সাকিবের করা ১৩ তম ওভারটি ছাড়া প্রতিটি ওভারেই একটি, দুটি বাউন্ডারি কিংবা ছক্কা মেরে গেছেন টি-টোয়েন্টির ওস্তাদ দুই ব্যাটসম্যান।
নিজেদের ইনিংস হাতে হাত রেখেই এগিয়ে নিয়েছেন ডি ভিলিয়ার্স ও হেলস। ভিলিয়ার্স পঞ্চাশ পূরণ করেন ২৪ বলে হেলস ৩৩ বলে। ডি ভিলিয়ার্স পরের পঞ্চাশ করলেন ২৬ বলে। হেলস বাকি রানটা করলেন আর ২০ বল খেলে। ডি ভিলিয়ার্সের শতরানে ছিল ৮টি চার ও ৬টি ছয়। হেলস মেরেছেন ৮টি চার ও তিনটি ছক্কা। ভিলিয়ার্স রুবেলের ১৭ তম ওভারটি থেকে তুলে নেন ১৬ রান। এই ওভারেই সেঞ্চুরি আর রংপুরের জয়ের পথে অনেকটাই এগিয়ে যান প্রোটিয়া তারকা।
শাহাদতের ১৮ তম ওভারের প্রথম বলেই ছক্কা মেরে ডি ভিলিয়ার্স জানিয়ে দেন সেঞ্চুরিটা পেতে তিনি বদ্ধ পরিকর। হেলসও তাঁকে দারুণ সহায়তা করেন। মারার বল পেয়েও এক রান নিয়ে স্ট্রাইক দেন তাঁকে। সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৩ রান দূরে তখন তিনি। ভিলিয়ার্স এরপর একটি দুই আর একটি সিঙ্গেলসে আরাধ্য সেঞ্চুরিটি পূরণ করে ফেলেন। পরিবারকে সময় দিতে বড় অসময়ের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়া ডি ভিলিয়ার্স যখন সেঞ্চুরি করে ব্যাট তুললেন জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের দর্শকেরা দাঁড়িয়ে। এমন ইনিংস বসে বসে দেখা যায় নাকি!
এমন একটা ইনিংস খেলেও বড় বিনয়ী ডি ভিলিয়ার্স। বললেন, এই ম্যাচটায় সেঞ্চুরি করেছেন সেটি বড় কিছু নয়। তিনি ম্যাচটা শেষ করে আসতে পেরেছেন আর তাতে দল জিতেছে বড় কথা সেটিই। এমন একটা ইনিংস দেখার পরেও রংপুর ম্যানেজমেন্টের মন খারাপ হতে হবে। ফাইনালে উঠলে ডি ভিলিয়ার্সকে তাঁরা পাবে কিনা সেটি নিয়ে শঙ্কা আছে। ৬ ম্যাচের জন্য চুক্তি ছিল। প্রোটিয়া তারকা নাকি এর বাইরে আর ম্যাচ খেলতে ইচ্ছুক নন। পরিবারকে সময় দেওয়াটাই তাঁর এই মুহূর্তের ইচ্ছা।
এখন দেখা যাক, রংপুর ডি ভিলিয়ার্সের মত বদলাতে পারে কিনা! বিপিএলের সৌন্দর্যের খাতিরেই এমন ব্যাটসম্যানকে যে শেষ অবধি প্রয়োজন।
সাকিবের দলকে হারিয়ে দিলেন মাশরাফি। এখন সাকিব কোনো আড্ডায় ম্যাশকে বলতেই পারেন, আমাদের যে একজন এবি ডি ভিলিয়ার্স কিংবা অ্যালেক্স হেলস ছিলেন না। এই জায়গাটাতেই বাজিমাত করে দিলেন মাশরাফি ভাই আপনি !