দেশে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না অসময়ের ডেঙ্গি সংক্রমণ। প্রতিদিনই এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গি আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে।
কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ডেঙ্গি ভাইরাসের স্থায়িত্ব বাড়ার কারণ সেরোটাইপ। এই ঊর্ধ্বমুখী ধারায় গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৬ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গিতে মৃতের সংখ্যা ১৯৯ জন হয়েছে। গত একদিনে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৯১৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। শনিবার ২৬৬ জন ভর্তি ও একজনের মৃত্যু হয়েছিল।
সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ৩ হাজার ২৭৫ জন ডেঙ্গি রোগী ভর্তি রয়েছেন। শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
জানতে চাইলে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. গোলাম ছরোয়ার বলেন, ডেঙ্গি ভাইরাসের স্থায়িত্ব বাড়ার কারণ সেরোটাইপ। ভাইরাসের সেরোটাইপ-১, সেরোপটাইপ-২, সেরোটাইপ-৩ ও সেরোটাইপ-৪ পর্যন্ত থাকে। বিগত বছরগুলোতে দেশে সচারচ সেরোটাইপ-১ ও ২ ছিল।
চলতি বছরে ডেঙ্গি রোগের তীব্রতা এবং ভয়াবহতা অনেক বেশি। এবারে ডেঙ্গির সেরোটাইপ ৩-৪ বেশি জটিলতা তৈরি করছে। এ দুধরনের ইনফেকশন বেশি হচ্ছে, এর ফলে ডেঙ্গির ভয়াবহতা বা মৃত্যু বেশি দেখা যাচ্ছে। এবার যেসব ডেঙ্গি রোগীর শক সিনড্রোম হচ্ছে। তাদের মধ্যে দ্বিতীয়বার আক্রান্তদের মৃত্যুহার বাড়ছে। ভাইরাসের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এডিস বাহক মশার জিনোটাইপ পরিবর্তন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করছে।
এবার সেটির প্রাধান্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আরেকটি বিষয় হলো-তাপমাত্রা বাড়লে মশার শরীরে ভাইরাসের স্থায়িত্ব বাড়তে পারে। শীতে তাপমাত্রা কম থাকায় সংক্রমণ কমে। এবার উলটোটা দেখা যাচ্ছে। তবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, আশা করা যায় তাপমাত্রা কমার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গির প্রকোপ কমে যাবে।
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গির মৌসুম ধরা হয়। তবে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ৪ মাস হলো ডেঙ্গির মূল মৌসুম। চলতি বছরের জুলাইর শেষ সপ্তাহ থেকে ডেঙ্গি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
এ বছর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেও ডেঙ্গি রোগের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক কারণে এবার দেরিতে বর্ষা এসেছে। থেমে থেমে বৃষ্টিপাতের কারণে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকায় এডিস মশার প্রজনন বেশি হয়ে দীর্ঘায়িত হয়েছে ডেঙ্গি মৌসুম।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ বছর অক্টোবরে সবচেয়ে বেশি ২১ হাজার ৯৩২ জন ডেঙ্গি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও ৮৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে নভেম্বরের প্রথম ১১ দিনে ৯ হাজার ৬৪৬ জন ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫৮ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সবশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৯১৮ জনের মধ্যে ঢাকায় ভর্তি ৫৩০ জন এবং ঢাকার বাইরে ৩৮৮ জন। নতুন আক্রান্তসহ বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকা ডেঙ্গি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ২৭৫ জনে।
অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ নভেম্বর সকাল পর্যন্ত ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৬ হাজার ৬৭০ জন। এরমধ্যে ঢাকায় ৩০ হাজার ৭৮২ জন এবং ঢাকার বাইরে রয়েছেন ১৫ হাজার ৯৭০ জন। তবে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৪৪ হাজার ১৯৬ জন। তাদের মধ্যে ঢাকা থেকে ২৯ হাজার ১৬৯ জন, ঢাকার বাইরে থেকে ১৫ হাজার ২৭ জন ছাড়পত্র পেয়েছেন।
এ বছর জানুয়ারিতে ১২৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২০ জন, মার্চে ২০ জন, এপ্রিল ২৩ জন, মে-তে ১৬৩ জন, জুনে ৭৩৭ জন, জুলাইয়ে ১ হাজার ৫৭১ জন, আগস্টে ৩ হাজার ৫২১ জন এবং সেপ্টেম্বরে ৯ হাজার ৯১১ জন, অক্টোবরে ২১ হাজার ৯৩২ জন রোগী ডেঙ্গি নিয়ে হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর এই সংখ্যা এ পর্যন্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
চলতি বছরের ২১ জুন ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রথম মৃত্যুর খবর জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অক্টোবরে সর্বোচ্চ ৮৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। জুনে ১ জন, জুলাইয়ে ৯ জন, আগস্টে ১১ জন এবং সেপ্টেম্বরে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে এই রোগে। ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে এবারই সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।