বাংলাদেশের ডেমরার ছেলে ফাহিম আলম ফ্রান্সে সাফল্যের নতুন এক ইতিহাস লিখেছেন; নৈরাশ্যের অন্ধকারে জীবনের আশাবরি গান শুনিয়েছেন; দাবা বোর্ডের সাদা-কালোয় অসাধারণ এক জয় ছিনিয়ে এনে বাংলাদেশের ভাগ্যহত লাখ লাখ অভিবাসী উন্মূল মানুষের জন্য এক বাতিঘরের সন্ধান দিয়েছেন।
২০১২ সালের ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল, আয়োজিত হয় ফ্রান্সের জাতীয় জুনিয়র (অনূর্ধ্ব-১২) দাবা। এখানেই খেলল বাংলাদেশের একটি ছেলে, নাম ফাহিম আলম। বয়স ১১। শুধু খেললই না, অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হলো। ৯ রাউন্ডের টুর্নামেন্টে সে ৭ রাউন্ডেই জিতল, বাকি দুই ম্যাচ ড্র। তার এই জয় আলোড়ন তুলল ফ্রান্সে; গোটা ইউরোপে, এমনকি পুরো দাবা-বিশ্বে।
ফ্রান্সের গণমাধ্যমে ঝড় বয়ে গেল। বড় শিরোনামে খবর হলো ঢাকার ডেমরা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের এক দেশে। কারণ, এই নির্মম পৃথিবীতে ছোট্ট ছেলেটির জীবন-জয়েরই গল্প ছিল এটি। তখন সে অবৈধ অভিবাসী হয়ে আক্ষরিক অর্থেই এক ছিন্নমূল। পলাতক জীবন কাটছে নানাজনের কাছে আশ্রিত হয়ে। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০০৮ সালে ফ্রান্সে ঢোকার পর তার বাবা নূরে আলম ফ্রান্সের নাগরিকত্বের আবেদন করেছিলেন রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে; যেমনভাবে এই দেশের অনেক মানুষ পশ্চিমা দেশে যায় ভাগ্যান্বেষণে। কিন্তু ফ্রান্স সরকার তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যান করায় ২০১০ সাল থেকেই তিনি ওই দেশে হয়ে পড়েন অবৈধ অভিবাসী।
অবৈধ হওয়া মানেই পুলিশের রক্তচক্ষু, যেকোনো মুহূর্তে ফিরতি বিমানে চেপে বুকের মধ্যে স্বপ্নের রক্তক্ষরণ নিয়ে দেশে ফেরার অপেক্ষা।
দেশত্যাগের সমন এল।
তাহলে কি হেরে যাবেন নূরে আলম? অনেক স্বপ্ন দেখে তিনি ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন ইউরোপে। ছেলেকে বানাবেন পেশাদার দাবাড়ু, একদিন যে চমকে দেবে দাবা-বিশ্বকে! প্রবল জলোচ্ছ্বাসে বিশ্বাসের দুপাড় ভাঙতে থাকা বাস্তবতায় ছেলেই বাবাকে জোগাল জয়ের সাহস। সেটি ফ্রান্সের এই জাতীয় জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়।
ফাহিম জেতার পর ফ্রান্সের অভিবাসন আইন নিয়ে প্রশ্ন তুললেন খোদ ফরাসিরাই। অভিবাসী আইনের এই কঠোর জালে আটকে কেন দাবার এই বালক-বীরের ভবিষ্যৎ ঢাকা পড়বে অনিশ্চয়তার মেঘে?
ঠিক ওই সময়ে ফ্রান্সে নির্বাচনী ডামাডোল। ফ্রান্সের জনপ্রিয় রেডিও স্টেশন ফ্রান্স ইন্টারে রাজনৈতিক বিতর্কে অংশ নিতে এসে সুশীল সমাজের চাপে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হলো ফাহিমকে নিয়েও। দাবি উঠল, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই ওর জন্য কিছু করতে হবে সরকারকে। প্রধানমন্ত্রী জানান, ফাহিমের ব্যাপারটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হবে। সেই বছর ১১ মে নূরে আলম পেয়ে গেলেন তিন মাসের অস্থায়ী ওয়ার্ক পারমিট। তিন মাস পার হলে দেওয়া হবে আরও দীর্ঘ সময়ের জন্য বসবাসের অনুমতি।
এদিকে ফ্রান্সের জুনিয়র জাতীয় দলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ফ্রেঞ্চ দাবা ফেডারেশনের কর্মকর্তা জর্ডি লোপেজ। নিজের জন্য নয়, ফাহিম বেশি খুশি তার বাবা অস্থায়ী ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ায়। বাবা না থাকলে কে জানে তার সামনের লড়াইটার বাঁকে বাঁকে কত অজানা আশঙ্কা ওত পেতে থাকত!
ফাহিমের যে অর্জন, তাতে আর নিঃসঙ্গ লড়তে হতো না তাকে। ২০০৮ সালের শেষ দিকে সে যখন প্যারিসের দক্ষিণ শহরতলি ক্রেতিলে এসে আশ্রয় নিল, ভর্তি হলো স্কুলে, বড় সহায় ছিল ক্রেতিল চেস ক্লাব। ওই ক্লাবের কোচ জেভিয়ার প্যারামিন্তেয়ার ছিলেন বড় ছায়া। আস্তে আস্তে সে তার দাবা-প্রতিভা দিয়ে জিতে নেয় ওই ক্লাবের সবাইকে, স্কুলের বন্ধু ও তাদের পরিবারের হৃদয়। দুই বছর না যেতেই ফাহিম হয়ে যায় পুরো ক্রেতিলের।
হবেই–বা না কেন? অমন শান্ত-ভদ্র আচরণ, তার ওপর ক্লাসেও প্রথম, দাবাতেও সেরা। দুই বছরের মধ্যে প্যারিসের আশপাশে অনেক শিরোপা জিতেছে সে। অনূর্ধ্ব-১৮, এমনকি অনূর্ধ্ব-২০ বছর বয়সীদের টুর্নামেন্টেও জিতেছে। সবশেষে জিতল জাতীয় জুনিয়র দাবা। সবার মন জিতে নেওয়াতেই তো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হয়নি বাবাকে সঙ্গে নিয়ে। বাবা-ছেলেকে আশ্রয় দিয়েছে ফাহিমের বন্ধুরা, ক্লাবের সতীর্থরা। বাংলাদেশসহ অন্য দেশের অভিবাসীরাও এসেছেন এগিয়ে। ফাহিম আজ আর ফ্রান্সে সহায়হীন নয়। ফরাসিরাই তার আত্মার আত্মীয় হয়ে গেছে।
২০১২ সালের ২৫ মে ফাহিমকে নিয়ে এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় । এরপর ফাহিম আর তাঁর বাবার অভিবাসী জীবনের ঘটনা নিয়ে কয়েকটি ভাষায় লেখা হয়েছে বই। এবার সেই বই অবলম্বনে ফাহিমকে নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি হলো প্যারিসে। ছবির নাম ‘ফাহিম’। পরিচালক পিয়ের ফ্রাঁসোয়া মার্তা-লাভাল। ১৬ অক্টোবর থেকে প্যারিসের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে চলবে ছবিটি। প্রদর্শনী হবে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে। তার আগে প্যারিসের অভিজাত প্রেক্ষাগৃহ গ্রন্দ রক্সে ছবিটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হলো। ১ ঘণ্টা ৪৭ মিনিটের ছবিটি উপভোগ করেছেন সহস্রাধিক দর্শক। প্রবাসীর কঠিন সংগ্রামী জীবনের বাস্তব গল্প নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্রটি দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়েছে।
‘ফাহিম’ চলচ্চিত্রে ফাহিমের চরিত্রে অভিনয় করে আসাদ আহমেদ আর তাঁর বাবার চরিত্রে মিজানুর রহমান। তাঁরা দুজনেই ফ্রান্সপ্রবাসী। ফাহিমের কোচের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন জনপ্রিয় ফরাসি অভিনেতা জেরার দেপারদ্যু।
জানা গেছে, এবারই প্রথম কোনো বাংলাদেশিকে নিয়ে ফ্রান্সে একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র তৈরি হলো। এই চলচ্চিত্রে বাবা আর ছেলের চরিত্রের বেশির ভাগ সংলাপে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। সঙ্গে আছে ফরাসি ভাষায় সাবটাইটেল। চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের কিছু দৃশ্য রয়েছে। বাংলাদেশিদের পাশাপাশি এই ছবিতে অভিনয় করেন ফরাসিরাও।
পরিচালক জানালেন, এই সিনেমা আপাতত বাংলাদেশে মুক্তি দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই।