দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন রক্ষায় সরকারের কোনো নির্দেশনা স্থানীয় প্রশাসন বাস্তবায়ন করছে না। এমনকি দ্বীপটি রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ১৩ দফা নির্দেশনাও কৌশলে এড়িয়ে প্রশাসন উলটোপথে হাঁটছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নামে ‘লোক দেখানো’ কয়েকটি ঝুপড়ি ঘর উচ্ছেদ করেছে প্রশাসন। অথচ গণমাধ্যমে অর্ধশতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদের সংবাদ প্রকাশিত হয়। বাস্তবতা হলো-এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই। অভিযোগ-টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিজেই সেন্টমার্টিনে খাস জমি দখল করে রিসোর্ট নির্মাণ করছেন।
সেন্টমার্টিনের চিহ্নিত ও আলোচিত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকঢোল পিটিয়ে অভিযানে নামে প্রশাসন। টেকনাফের ইউএনও পারভেজ চৌধুরী এ অভিযানের নেতৃত্ব দেন। অভিযানে অসহায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অস্থায়ী ছয়টি ঝুপড়ি দোকান ও তিনটি ফিশারি উচ্ছেদ করা হয়। অথচ পরেরদিন দেশের প্রায় সব মূলধারার গণমাধ্যমে অর্ধশতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদের সংবাদ প্রকাশিত হয়। জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের দাবি, সেন্টমার্টিনের উত্তর-পূর্ব, পশ্চিম ও কোনাপাড়া সৈকত দখল করে আড়াই শতাধিক অবৈধ দোকানপাট বসিয়েছে প্রভাবশালীরা। কিন্তু এগুলো উচ্ছেদ করা হয়নি। এ কারণে প্রভাবশালীদের রক্ষায় এ উচ্ছেদ অভিযানকে ‘আই-ওয়াশ’, ‘আয়নাবাজি’ ও ‘লোক দেখানো’ হিসাবে অভিহিত করেছে স্থানীয়রা।
সেন্টমার্টিনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, শুক্রবার অভিযানে অসহায় স্থানীয়দের কয়েকটি দোকান ও কয়েকটি ফিশারি উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু প্রভাবশালীদের স্থাপনাগুলো এবং নির্মাণাধীন স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করেনি প্রশাসন। অর্ধশতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি প্রশাসনই ভালো বলতে পারবে।
উচ্ছেদ হওয়া কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগ-বিভিন্ন স্থানে বড় বড় নির্মাণাধীন অবৈধ স্থাপনা অক্ষত রেখে প্রশাসন শুধু লোক দেখানো অভিযানে ছোট ছোট টং ও ত্রিপলের দোকান, বাঁশের বেড়ার ভাসমান স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে। প্রভাবশালীদের একটি অবৈধ স্থাপনাও উচ্ছেদ করা হয়নি। বরং অবৈধ ভবনগুলোর নির্মাণ কাজ পুরোদমে চলছে। ঝুপড়ি চায়ের দোকানদার মিজানের অভিযোগ-এখনো সেন্টমার্টিনে বড় বড় রিসোর্ট নির্মাণ চলছে। অথচ অসহায়-গরিব লোকদের দোকানপাট ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। এ সময় তিনি প্রশ্ন তোলেন-উচ্ছেদ অভিযান কী শুধু গরিব ও ছোট স্থাপনার বিরুদ্ধে?
পরিবেশবাদী সংগঠন ইনভায়রমেন্ট পিপল-এর প্রধান নির্বাহী রাসেদুল মজিদ যুগান্তরকে বলেন, সেন্টমার্টিনে উচ্ছেদ অভিযানের নামে আই-ওয়াশ করা হচ্ছে। প্রভাবশালীদের ভবনগুলোর কাজ ঠিকই চলছে। অভিযোগ করে তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা প্রকাশ্যে রিসোর্ট নির্মাণ করছেন। ওই রিসোর্ট নির্মাণে সরকারি জমিও দখল করা হয়েছে। এ রিসোর্টটি উচ্ছেদ করতে পারলে বুঝা যাবে প্রশাসন আসলে কতটা আন্তরিক।
স্থানীয়দের দাবি, ব্ল–মেরিন রিসোর্টের দক্ষিণ পাশে খাস জমি দখল করে টেকনাফের ইউএনও নিজেই অবৈধভাবে রিসোর্ট নির্মাণ করছেন। তবে ব্যক্তিগত রিসোর্ট নির্মাণের অভিযোগ প্রসঙ্গে ইউএনও পারভেজ চৌধুরী বলেন, কোনো রিসোর্ট নির্মাণ করা হচ্ছে না। অভিযানের সুবিধার্থে কাঠ-বাঁশের বিশ্রামঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। নির্মাণাধীন তিনতলা ভবনটি টয়লেট বলে দাবি করে তিনি আরও বলেন, প্রয়োজন হলে সেটাও ভেঙে ফেলা হবে। ১১ ফেব্রুয়ারির অভিযানে মাত্র নয়টি ঝুপড়ি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হলেও গণমাধ্যমে অর্ধশতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদের তথ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘হয়তো গণমাধ্যম ওইভাবেই সংবাদ ছাপিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, উচ্ছেদ হওয়া লোকজনকে অন্য কোনো জায়গায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।
চিহ্নিত ও আলোচিত নির্মাণাধীন ভবন উচ্ছেদ না করার বিষয়ে ইউএনও পারভেজ চৌধুরী বলেন, প্রস্তুতির একটা বিষয় আছে। আগামীতে ধীরে ধীরে সব উচ্ছেদ করা হবে।
টেকনাফ ইউএনও’র রিসোর্ট নির্মাণ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মামুনুর রশিদ যুগান্তরকে বলেন, সেন্টমার্টিনে অভিযান করতে গেলে বসা ও বিশ্রাম নেওয়ার কোনো স্থান না থাকায় কাঠ ও বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী বিশ্রামাগার (দুটি ঘর) নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশে কোনো ভবন হচ্ছে কিনা এবং সেটা ইউএনও’র কিনা তা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। তিনি আরও বলেন, সেন্টমার্টিন রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে সেসব বাস্তবায়ন করা হবে।