দর্শক চাহিদার কারণেই চলচ্চিত্রে নায়ক-নায়িকাদের মধ্যে জুটি প্রথার সৃষ্টি হয়। যা শুধু ঢাকাই ছবিতেই নয়, হলিউড-বলিউডেও এই জুটিপ্রথার জয়জয়কার। ঢাকাই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির শুরু থেকেই জুটিপ্রথা গড়ে উঠেছে। এই জুটিপ্রথার কাঁধে ভর করেই ইন্ডাস্ট্রিতে উপহার দিয়েছেন জনপ্রিয় সব ছবি। এই প্রথা চলছে এখনও। ঢাকাই ছবির সেসব সফল জুটি নিয়েই এ আয়োজন।
রাজ্জাক-কবরী
ঢাকাই ছবির সবচেয়ে সফল জুটি বলা হয় রাজ্জাক-কবরীকে। ১৯৬৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এ জুটির ছবি জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সুভাষ দত্তের ছবি ‘আবির্ভাব’র মাধ্যমে জুটি হয়ে প্রথমবার রূপালি দুনিয়ায় হাজির হন তারা। এর পরের কথা তো ইতিহাস। ১৯৬৯ সালে কাজী জহিরের ‘ময়নামতি’ ও মিতার ‘নীল আকাশের নিচে’, ১৯৭০ সালে নজরুল ইসলামের ‘দর্পচূর্ণ’, মিতার ‘দীপ নেভে নাই’, কামাল আহমেদের ‘অধিকার’ নামের রাজ্জাক-কবরী জুটির ছবিগুলো দারুণ মুগ্ধতা ছড়ায় দর্শকদের মাঝে। সে সময় উর্দু ভাষার সিনেমার রমরমা বাজারও ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি বাঙালি এ জুটির ছবিগুলোকে। উর্দু ছবির জনপ্রিয় জুটি শবনম-রহমান ও শাবানা-নাদিমের দাপট ডিঙ্গিয়ে রাজ্জাক-কবরী হয়ে ওঠেন বাংলা ছবির সফল প্রতিনিধি।
এ তো গেল স্বাধীনতার আগের ইতিহাস। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ছবিতেও সফলতার ধারাবাহিকতা সমান গতিতে চলেছে তাদের। এ সময় এ জুটির অভিনীত ‘রংবাজ’ ছবিটি ব্যাপক ব্যবসা সফল হিসেবে আজও ইতিহাস হয়ে আছে। এ ছবির ‘সে যে কেন এল না, কিছু ভালো লাগে না’ গানটি দর্শকের মুখে মুখে ফিরতে থাকে বহুবছর। এসময় রোমান্টিক জুটি হিসেবেই তারা পরিচিতি পায়। ক্যারিয়ারের ষাটের অধিক সিনেমায় মুক্তি পেয়েছে এ জুটির মধ্যে ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘ময়নামতি’, ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’, ‘পরিচয়’, ‘অধিকার’, ‘বেঈমান’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘সোনালী আকাশ’, ‘অনির্বাণ’, ‘দীপ নেভে নাই’সহ একাধিক সিনেমা। নিজের সাফল্যের কারণে রাজ্জাককে বাংলার নায়ক রাজ উপাধিতে ভূষিত করেন দর্শকরা। পরে এ নায়ক বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও তাদের জুটি থেমে থাকেনি। শেষে ‘আমাদের সন্তান’ নামের একটি ছবিতে রাজ্জাক-কবরীকে বাবা-মায়ের ভূমিকায়ও অভিনয় করতে দেখা গেছে।
আলমগীর-শাবানা
ঢাকাই ছবির আরেক সফল জুটির নাম শাবানা-আলমগীর। পরিচালক এহতেশামের হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্রের ভুবনে পা রাখেন রত্না নামের একটি মেয়ে। কিন্তু চলচ্চিত্রে রত্না নামটি রাখতে চাইলেন না পরিচালক। তাই রত্না থেকে শাবানা রাখলেন এহতেশাম। যে নাম নিয়েই দর্শকদের সামনে ভেসে ওঠে কখনও প্রেমিকা কখনও ভাবী কখনও প্রতিবাদী এক চরিত্রের মেয়ের চরিত্র। ঢাকাই চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য আশীর্বাদ নায়িকা ছিলেন শাবানা। ৭০-৯০ দশক পর্যন্ত দুর্দান্ত প্রতাপে রাজত্ব করে গেছেন এ নায়িকা। দীর্ঘ এ ক্যারিয়ারে তৎকালীন বেশ কযেকজন সফল নায়িকার সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন তিনি। এই বেশ ক’জন নায়কের মধ্যে আলমগীরের সঙ্গে তার জুটি দর্শকরা সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করেছেন। তাই সে সময় আলমগীর-শাবানা জুটি মানেই গ্রামবাংলা ও নগরের সামাজিক ও পারিবারিক ছবির জুটি। এ জুটিই ঢাকাই সর্বাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন। তাদের অভিনীত ছবির সংখ্যা ১২৬টি। বিশাল সংখ্যার এ ছবির বেশিরভাগই ব্যবসাসফল। তাই নায়িকাদের মধ্যে পুরস্কার পাওয়ার সংখ্যা শাবানার ক্ষেত্রেই বেশি। আলমগীরও কিন্তু কম না। এ পর্যন্ত আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পদক পেয়েছেন তিনি।
নাঈম-শাবনাজ
তখন ১৯৯০ সাল। প্রয়াত বরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশাম তার নতুন চলচ্চিত্র ‘চাঁদনী’র জন্য দুজন নতুন মুখ বাছাই করেন। সেই দুজনই হল, নবাব পরিবারের ছেলে নাঈম আর বিক্রমপুরের মেয়ে শাবনাজ। প্রথম ছবিতেই জুটি হিসেবে ব্যাপক সাড়া ফেলেন নাঈম-শাবনাজ। এরপর তারা একের পর এক অভিনয় করেন ‘লাভ’, ‘চোখে চোখে’, ‘দিল’, ‘টাকার অহঙ্কার’, ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’, ‘সোনিয়া’ ও ‘অনুতপ্ত’সহ আরও বেশ কয়েকটি ছবিতে। প্রতিটি ছবিই জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল হয়েছিল। নাঈম-শাবনাজের আগমনের আগে কিছুটা হলেও দুঃসময়ে পড়েছিল দেশীয় চলচ্চিত্র। কিন্তু সেই দুঃসময়টা বেশিদিন টিকতে পারেনি। নাঈম-শাবনাজের মাধ্যমেই নব্বই দশকের বাংলা চলচ্চিত্র আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়। শুরু হয় চলচ্চিত্রের নতুন স্বর্ণযুগের। যার রেশ ধরে আগমন সালমান শাহ, মৌসুমী ও শাবনূরের মতো মহাতারকার। চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে গিয়েই ঘনিষ্ঠ হন নাঈম-শাবনাজ। শুরু থেকেই তাদের প্রেম কাহিনী মিডিয়ায় আসে। কিন্তু প্রথা অনুযায়ী সেসব অস্বীকার করলেও অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনা ভেঙে ১৯৯৬ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন এ জুটি। এরপর ২০০০ সালের প্রথম দিকে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা শুরু হলে নীরবে এ জগত থেকে আড়ালে চলে যান তারা। নব্বই দশকের বাংলা চলচ্চিত্র, এমনকি সার্বিক বিচারে বাংলা চলচ্চিত্র যাদের কাছে ঋণী, তাদের অন্যতম এ দুজন এখন নিভৃত জীবন নিয়ে ভালো আছেন। চলচ্চিত্র তারকাদের জীবনে স্বাভাবিক যে কালিমার রেশ থাকে, তার কোনো ছিটেফোঁটাও নেই তাদের ব্যক্তি জীবনে। বিয়ের পর দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগেরও বেশি সময় পেরিয়ে আসা এ জুটির সময় কাটে দু’মেয়ে, সংসার আর ব্যবসা নিয়ে।
সালমান শাহ-শাবনূর
নব্বই দশকের শুরুর দিকে ঢাকাই ছবির রূপালি জগতে আবির্ভাব হয় বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ সালমান শাহর। এ সময় তার হাত ধরেই চলচ্চিত্র শিল্প নতুন গতি পায়। নতুন নতুন ছবি মুক্তির মাধ্যমে ইন্ডাস্ট্রিও লাভের মুখ দেখতে থাকে। শুরুর দিকে সালমানের সঙ্গে জুটি হয়ে চারটি ছবিতে অভিনয় করেছেন মৌসুমী। পরে ১৯৯৪ সালে ‘তুমি আমার’ চলচ্চিত্রে মাধ্যমে সালমানের সঙ্গে জুটি হন শাবনূর। প্রথম ছবিতেই ব্যাপক সফলতা পায় এ জুটি। যার ফলে পরিচালক-প্রযোজকরা একের পর এক ছবিতে নিতে থাকেন তাদের। সালমান অভিনীত ২৭টি ছবির মধ্যে ১৪টি ছবিতেই তার বিপরীতে অভিনয় করেছেন শাবনূর। ঢাকাই ছবির জগতে অন্যতম সফল এই মহাকাব্যিক রোমান্টিক জুটি ভক্তদের কতটা ভেতরে প্রবেশ করতে পেরেছিল, তা তো সবাই-ই জানেন। তরুণদের পোশাকে সালমানের কালোত্তীর্ণ ফ্যাশন, কণ্ঠে সালমানের সিনেমার গান। সালমানের মাথায় কাপড় প্যাঁচানো, হ্যাট, চশমা, গেঞ্জি, কী নকল হয়নি তখনকার তরুণদের মাঝে! সবাই ভাবত তাদের মধ্যে বাস্তবেও বোধহয় ভিন্নরকম সম্পর্ক ছিল। এসব নিয়ে কম কথাও রটেনি। সালমান বেঁচে থাকলে হয়তো আরেকটি উত্তম-সুচিত্রা জুটি হতে পারত সালমান-শাবনূর। তাদের দিয়ে বানানো যেত ‘হারানো সুর’, ‘সাগরিকা’, ‘সপ্তপদী’র মতো অনেক কালজয়ী চলচ্চিত্র। তবে যে কটি সিনেমায় একসঙ্গে তারা ছিলেন, তার মধ্যে ‘তোমাকে চাই’, ‘জীবন সংসার’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘আনন্দঅশ্রু’, ‘স্বপ্নের নায়ক’সহ প্রায় প্রত্যেকটিই এখনও দর্শক দারুণভাবে মনে রেখেছেন।
ইলিয়াস কাঞ্চন ও দিতি
‘নতুন মুখের সন্ধানে’ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে নিজেকে পুরোপুরি জড়িয়ে নেন দিতি। তার অভিনীত প্রথম ছবি ছিল প্রয়াত পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর ‘ডাক দিয়ে যাই’। এ ছবিতে তাকে আফজাল হোসেনের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। কিন্তু আশি শতাংশ কাজ শেষ করার পরও ছবিটি আলোর মুখ দেখেনি। দিতির মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি প্রয়াত পরিচালক আজমল হুদা মিঠুর ‘আমিই ওস্তাদ’। এ ছবিতে দিতির অনবদ্য অভিনয় দর্শকের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছিলেন প্রয়াত এ নায়িকা। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে দিতি সবচেয়ে বেশি জুটিবদ্ধ হয়ে অভিনয় করেছেন। তাই সফল জুটির তালিকায় তাদের নামও উল্লেখযোগ্য।
ওমর সানী-মৌসুমী
অভিনয়ে জুটি হয়ে প্রায় চব্বিশ বছর পার করছেন ওমর সানী ও মৌসুমী জুটি। এই তেইশ বছরে মৌসুমী ওমর সানী ৪০টি সিনেমায় একসঙ্গে অভিনয় করেছেন। এ জুটির প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ‘দোলা’। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল। এর পর তাদের অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে ‘আত্ম অহঙ্কার’, ‘প্রথম প্রেম’, ‘মুক্তির সংগ্রাম’, ‘হারানো প্রেম’, ‘গরিবের রানী’, ‘প্রিয় তুমি’, ‘সুখের স্বর্গ’, ‘মিথ্যা অহঙ্কার’, ‘ঘাত প্রতিঘাত’, ‘লজ্জা’, ‘কথা দাও’ ‘স্নেহের বাঁধন’ ইত্যাদি। তাদের মুক্তিপ্রাপ্ত সর্বশেষ চলচ্চিত্র হচ্ছে শাহীন সুমনের ‘সাহেব নামে গোলাম’। এটি ২০০৯ সালে মুক্তি পায়। এর সাত বছর পর তারা জুটিবদ্ধ হয়ে অভিনয় করেছেন প্রয়াত বেলাল আহমেদের নির্দেশনায় ‘ভালোবাসবোই তো’ চলচ্চিত্রে। শালমান শাহর আর মৌসুমী যখন জুটি প্রথা ভেঙে আলাদা পথে পা বাড়ায় তখন সালমান শাহ শাবনূরের সঙ্গে জুটি বাঁধেন আর মৌসুমী বাঁধেন ওমর সানীর সঙ্গে। যা পরবর্তীতে পর্দা থেকে বাস্তাবে রূপ লাভ করেছে। এ জুটির বর্তমানে এক ছেলে এক ও মেয়ে নিয়ে সুখেই জীবনযাপন করছেন।
বর্তমানে ঢাকাই ছবির সফল জুটির তালিকা করলে শাকিব খান আর অপু বিশ্বাস ছাড়া কাউকে পাওয়া যাবে না। কিছুদিন আগেও এ জুটির ছবি মুক্তি মানেই ব্যবসায়িকভাবে সফল। তাই এ জুটিকে নিয়ে ছবি বানাতে নির্মাতাদের আগ্রহের কমতি ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই অপু উধাও হওয়াতে ভাটা পড়েছে এ জুটির ছবির সাফল্যে। বগুড়ার মেয়ে অপু বিশ্বাস অবন্তি। ২০০৪ সালে আমজাদ হোসেনের ‘কাল সকালে’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে পদার্পণ করেন। এরপর এফআই মানিক পরিচালিত ‘কোটি টাকার কাবিন’ ছবিতে শাকিব কানের সঙ্গে জুটি হয়ে অভিনয় করেন। ছবিটি ব্যবসাসফল হওয়ার পর অপু বিশ্বাস রাতারাতি তারকায় রূপান্তরিত হন। শীর্ষ নায়ক শাকিব খানের সঙ্গে তার জুটি দর্শকদের গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়। ফলে ‘কোটি টাকার কাবিন’ ছবিটির এই জুটির ‘পিতার আসন’, ‘চাচ্চু’, ‘দাদি মা’, ‘মিয়া বাড়ির চাকর’, ‘জন্ম তোমার জন্য’, ‘মায়ের হাতে বেহেশতের চাবি’ প্রভৃতি ছবিও সুপারহিট ব্যবসা করে। ধুম পড়ে যায় শাকিব-অপু জুটিকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের। মজার ব্যাপার হল, অপু বিশ্বাস অভিনীত ৫০টি ছবির মধ্যে ৪০টিতেই তিনি অভিনয় করেছেন শাকিব খানের বিপরীতে।