রফতানি বাণিজ্যে আবার যুক্ত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিন। দামি পোশাক হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি রয়েছে এই মসলিনের। রাজপরিবারসহ অভিজাত শ্রেণির পোশাক হিসেবে বিশেষ কদর পাওয়া মসলিনের বাণিজ্যিক উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রায় সোয়া দুইশ’ বছর পর ঢাকাই মসলিনের আবার বাণিজ্যিক উৎপাদনের মাধ্যমে ফ্যাশন জগতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে।
হাল ফ্যাশনে বিশ্ববাজারে এ ধরনের মিহি কাপড়ের চাহিদা বেড়েছে ব্যাপক। মসলিন তৈরি হতো সবচেয়ে মিহি ৩০০ কাউন্টের সুতা দিয়ে। বিশেষ ধরনের ফুটি কার্পাস তুলা ছাড়া এতটা সূক্ষ্ণ সুতা হয় না। হারিয়ে যাওয়া সেই ফুটি কার্পাসের জাত শনাক্ত করা হয়েছে। এখন পরীক্ষামূলক চাষ হচ্ছে ফুটি কার্পাসের। ফুটি কার্পাসের তুলায় তৈরি ৩০০ কাউন্টের সুতায় মাত্র ১৭০ গ্রাম ওজনের একটি শাড়ি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দিয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। নিজস্ব সম্পদ হিসেবে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) সনদ পেতে আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব সংস্থা ডব্লিউআইপিও বরাবর আবেদনও করা হয়েছে এরই মধ্যে।
তৈরি পোশাক পণ্যের দ্বিতীয় প্রধান রফতানিকারক হিসেবে বাংলাদেশ এখন বিশ্ববাজারে মর্যাদা ভোগ করছে। মোট রফতানি আয়ে পোশাকের অবদান প্রায় ৮৫ শতাংশ। এই হার প্রতি মাসেই বাড়ছে। বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের এ অবস্থানের হাতেখড়ি হয়েছিল এই মসলিন দিয়েই। ব্রিটিশ শাসনকালে সোনারগাঁর আড়ং থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার মসলিন রফতানি দিয়ে শুরু হয়। ইউরোপ, আরব, আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে রাজকীয় পোশাক হিসেবে ঢাকাই মসলিনের ব্যাপক কদর তৈরি হয়। তবে সারাবিশ্বে কৌলীন্য ছড়ানো ঢাকাই মসলিন শেষ পর্যন্ত নিজের কুল রক্ষা করতে পারেনি। প্রায় সোয়া দুইশ’ বছর আগে মসলিনের জৌলুস ও বাজার খোয়া যায়। এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায় উৎপাদন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আগ্রহে আবার ফিরেছে মসলিন। মসলিনের সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার নামে একটি প্রকল্প নিয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। ‘বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিনের সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার’ প্রকল্পের অধীনে মসলিন কাপড় তৈরির কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
তাঁত বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, উইভিংয়ের অগ্রগতি ৮০ ভাগ। মসলিনের তুলা ও সুতা শনাক্তকরণ-সংক্রান্ত গবেষণা কার্যক্রমের অগ্রগতি ২০ এবং স্পিনিংয়ের অগ্রগতি ৫৫ ভাগ এগিয়েছে। তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন-বিটিএমসি এবং বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর গত বছরের জুনে প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হয়। আগামী ডিসেম্বরে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হবে। শাড়ি ছাড়াও আন্তর্জাতিক চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে ফ্যাশনদুরস্ত পোশাক করা গেলে বর্তমানের মৌলিক মানের পোশাক থেকে উচ্চমূল্যের পোশাক রফতানির সুযোগ নেওয়া সম্ভব হবে। রফতানি পণ্যে বৈচিত্র্য আসবে। স্থানীয় বাজারেও মিলবে মসলিন। তবে দাম কিছুটা বেশিই হবে। একটি মসলিন শাড়ির দাম পড়বে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা।
জানতে চাইলে তাঁত বোর্ডের পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন বিভাগের প্রধান মো. আয়ুব আলী বলেন, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মসলিন উৎপাদনের জন্য দেশের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন তারা, যাতে মসলিনের উৎপাদন কৌশল, তুলাসহ কাঁচামাল সম্পর্কে তাদের সম্যক অবহিত করা যায়। কারণ, সরকার মসলিনকে বাণিজ্যিক উৎপাদনের উপযোগী পর্যায়ে নিয়ে আসছে। তবে রফতানি বাণিজ্য কিংবা দেশের বাজারে মসলিনের বাণিজ্যিক সরবরাহের কাজটি উদ্যোক্তারাই করবেন। তিনি জানান, আগের সেই অবিকল ঢাকাই মসলিন উৎপাদন সম্ভব। সম্পূর্ণ হাতে তৈরি হওয়ায় আপাতত একটা মসলিন শাড়ির মূল্য পড়বে ৫০ হাজার টাকার মতো। অবশ্য উৎপাদন দক্ষতা বাড়লে ব্যয় কমে আসবে। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হলে রফতানিতে উচ্চ মূল্যের একটি পণ্য যুক্ত হবে। আয় বাড়বে বড় অঙ্কে।
সূত্র জানিয়েছে, মসলিন বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন প্রযুক্তি, মসলিন তৈরির বিশেষ তুলা গাছ হারিয়ে যায়। ইতিহাস ঘেঁটে গবেষণার পর মসলিনের সুতার জন্য উপযোগী তুলা গাছ ফুটি কার্পাস শনাক্ত করা হয়েছে। গাছটির একটি নমুনা স্কেচ তৈরি করে অনুরূপ গাছ খুঁজে বের করতে পার্বত্য চট্টগ্রাম, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন বনবাদাড়ে ৫০০ শিক্ষার্থীকে পাঠানো হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর কাপাসিয়ায় ফুটি কার্পাসের সন্ধান পাওয়া যায়। পরে চাষ শুরু হয়। বছরে দু’বার ফলন পাওয়া যাবে ফুটি কার্পাস থেকে। ঠিক মসলিনের কারিগর না পাওয়ায় আদি-খাদির কারিগরদের এনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। জাপানের তায়ামো বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ঢাকাই মসলিন বিষয়ে গবেষণা অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। জিআই পণ্য হিসেবে ঢাকার দাবির কারণে তারা মসলিন থেকে সরে আসেন। এরই মধ্যে জিআই সনদের জন্য আবেদন করেছেন তারা।
প্রকল্প এগিয়ে নিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের পরিচালক অধ্যাপক মনজুর হোসেনের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। জানতে চাইলে অধ্যাপক মনজুর হোসেন বলেন, কাজে নেমে তারা দেখেন, আদি-আসল মসলিনের নমুনা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে মসলিনের খোঁজে গিয়েছিলেন তারা। সেখানে ঢাকাই মসলিন পাওয়া গেছে। ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশকে নমুনা দিয়ে সহযোগিতা করেছে। আদি মসলিন যে তুলার সুতায় তৈরি হতো সেই ফুটি কার্পাস উদ্ধার করা হয়েছে। অধ্যাপক মনজুর হোসেনের মতে, রফতানিমুখী তৈরি পোশাক খাতে এখন তুলার যে বিশাল আমদানি চাহিদা তা উন্নত দেশি ফুটি কার্পাস দিয়েই মেটানো সম্ভব হবে। কারণ, উচ্চমূল্যের পোশাক উৎপাদনে এ ধরনের তুলা খুবই উপযোগী।
তবে এই প্রত্যাশার বিপরীতে কিছুটা ভিন্নমত দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর।তিনি বলেন, এ ধরনের উদ্যোগ জাতির জন্য সুখবর। বৈচিত্র্যহীন রফতানিমুখী তৈরি পোশাক পণ্যে বৈচিত্র্য আসবে। মূল্য সংযোজিত পণ্যের মাধ্যমে রফতানি বাণিজ্যে বড় ধরনের সুবিধা করে নিতে পারবে বাংলাদেশ। সমস্যা হচ্ছে, সরকারি খাতে যে কোনো উদ্যোগেরই সফলতা নিয়ে সংশয় থাকে। বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত না করলে এ উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত কতটা সফল হবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তিনি বলেন, গবেষণা ও উৎপাদন দুই পর্যায়েই বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করা গেলে খুব সফলভাবে ঢাকাই মসলিন আবার বিশ্বজয় করতে পারবে। উচ্চমূল্যের পোশাক উৎপাদনের মাধ্যমে রফতানি বাণিজ্যে শক্তিশালী অবস্থান করে নিতে পারবে বাংলাদেশ।