ঢাকার ভোটের আগে ইসিতে ফের দ্বন্দ্ব

cec-huda

নানা বিষয়ে নিজের ভিন্নমত প্রকাশ্যে এনে বিভিন্ন সময়ই আলোচনায় আসছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। এবার ঢাকা সিটি ভোটের আগে তিনি অভিযোগ তুলেছেন, কমিশনে উপেক্ষিত হচ্ছেন তিনি।

বর্তমান ইসিতে এর আগে কর্তৃত্ব নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার সঙ্গে কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বে সহকর্মীদের পাশে পেলেও এবার সেখান থেকেও সমর্থন পাচ্ছেন না মাহবুব তালুকদার।

মাহবুব তালুকদারের সর্বশেষ অভিযোগকে ‘উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ মনে করছেন আরেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম।

নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. আলমগীরও কড়া জবাব শুনিয়ে মাহবুব তালুকদারকে বলেছেন, বিশেষ কোনো নির্বাচন কমিশনারকে তথ্য দিতে তারা বাধ্য নন।

নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশনে মাহবুব তালুকদার এর আগে বিভিন্ন সময় ভিন্নমত জানিয়ে আনঅফিসিয়াল নোট দিয়েছিলেন, সভা বর্জনের ঘটনাও ঘটিয়েছিলেন তিনি।

আগামী ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন আয়োজনের শুরুতেও তিনি অনিয়ম ঠেকাতে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের তৎপরতাহীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

বিএনপির প্রার্থীরা যখন নির্বাচন সমান সুযোগ না পাওয়ার অভিযোগ তুলে সরব, তখনই ইসির ভেতরেই ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই’ বলে দাবি করলেন মাহবুব তালুকদার।

রোববার নির্বাচন ভবনে নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে বরাবরের মতোই লিখিত একটি বক্তব্য দেন তিনি, তাতে তিনি দাবি করেন, কমিশনে তার কথা বলার জায়গা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে।

মাহবুব তালুকদার বলেন, “নির্বাচন কমিশন সভায় আমার প্রস্তাব বা সুপারিশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে অগৃহীত হয়। আমার ধারণা, কমিশন সভায় আমার বক্তব্য প্রদানের স্থান সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। ইসির অভ্যন্তরেই কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই।

“আমাকে সংখ্যালঘিষ্ঠ হিসেবে না দেখে আমার বক্তব্যের বিষয়বস্তুর মেরিটকে বিবেচনায় নেওয়া সমীচীন বলে মনে করি। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষা করতে আমাদের কর্মকাণ্ডে তা দৃশ্যমান হওয়া বাঞ্ছনীয়।”

এই নির্বাচন কমিশনারের অভিযোগ, নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীর পক্ষ থেকে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে যেসব অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, তা নিয়ে কমিশনে কোনো আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ‘লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না’।

“এসব অভিযোগের পেছনে যে অসন্তোষ আছে, তা বিস্ফোরিত হলে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন যথাপযুক্তভাবে অনুষ্ঠিত হবে না, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এর দায়ভার নির্বাচন কমিশনকে বহন করতে হবে।“

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচন নিয়ে নিজের কিছু বক্তব্য থাকার কথা তুলে ধরে মাহবুব তালুকদার বলেন, “এই নির্বাচন সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের যেভাবে দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন, তা হচ্ছে না।

“উক্ত নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণার পর থেকে আজ পর্যন্ত যে তিনটি কমিশন সভা অনুষ্ঠিত হয়, তার কোনোটিতে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আচরণবিধি, অনিয়ম বা প্রার্থীদের অভিযোগ সম্পর্কে কোনো আলোচনা হয়নি। এছাড়া কোনো কমিশন সভায় এসব বিষয় এজেন্ডাভুক্ত হয়নি।”

ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে গত ৯, ১৩, ১৬ ও ২০ জানুয়ারি তার দেওয়া চারটি আনঅফিসিয়াল (ইউও) নোট ‘রীতিমতো উপেক্ষা’ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের নির্বাচনের দুই রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছেও উপেক্ষার শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন এই নির্বাচন কমিশনার, যারা নির্বাচন কমিশনেরই কর্মকর্তা।

মাহবুব তালুকদার বলেন, ১৬ জানুয়ারি দেওয়া ইউও নোটের মাধ্যমে ইসি সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দুই রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে প্রার্থীদের বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে তথ্যাদি জানাতে চেয়েছিলেন তিনি।

“এসব অভিযোগের বিষয়ে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে ২০ জানুয়ারির মধ্যে আমার কাছে পেশ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার সেই নির্দেশ উপেক্ষিত হয়েছে। কোনো তথ্যই আমাকে সরবরাহ করা হয়নি।”

নানা অভিযোগ তোলার পর গত বছর মাহবুব তালুকদার একবার বলেছিলেন, বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে সিইসির দ্বিমত হলেও কোনো মতবিরোধ নেই।

কিন্তু এরপর তাদের দূরত্ব কমেনি।

এভাবে ‘উপেক্ষিত’ হতে থাকলে কী করবেন, প্রশ্ন করা হলে মাহবুব তালুকদার সাংবাদিকদের বলেন, “সময়ই বলবে করণীয় কী হবে ভবিষ্যতে।”

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত: রফিকুল

ইসিতে সিইসি নূরুল হুদার ‘একক কর্তৃত্ব’ নিয়ে কিছু কাল আগে যখন প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, তখন মাহবুব তালুকদারের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদাত হোসেন চৌধুরীও ছিলেন।

কিন্তু রোববার যে অভিযোগ মাহবুব তালুকদার তুললেন, তা নিয়ে ভিন্ন অবস্থানে রয়েছেন রফিকুল ইসলাম।

এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “একজন নির্বাচন কমিশনারের এ ধরনের বক্তব্য (ইসির ভেতরে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই) দুঃখজনক। সেই সঙ্গে আমি অবাকও।“

মাহবুব তালুকদারকে ইঙ্গিত করে রফিকুল বলেন, “যদি কেউ একক সত্তার মধ্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড খোঁজেন, আমি তো বলব, এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং কমিশনকে বিভাজিত করার ও প্রশ্নবিদ্ধ করার একটা প্রয়াস মাত্র।”

তিনি বলেন, “এখানে ওয়ান আইডেনটিটি; এখানে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। তাহলে কেউ (কেন) কারও প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন? আমি কিন্তু তা ভাবি না।”

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ভোট নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দিক-নির্দেশনা দেওয়ার অনুষ্ঠানে সিইসি কে এম নূরুল হুদাসহ নির্বাচন কমিশনাররা (ফাইল ছবি)

কমিশন সভায় বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে – মাহবুব তালুকদারের এমন দাবিও নাকচ করে দেন সহকর্মী রফিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “উনি প্রস্তাব করেছিলেন (ঢাকা সিটি নির্বাচনে) দুই রিটার্নিং কর্মকর্তার জন্য। একজনের ভিন্নমত ছিল, তারপরও উনার প্রস্তাব অনুযায়ী তাদের (রিটার্নিং কর্মকর্তা) করা হয়েছে। যিনি ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন ,তার প্রস্তাব আমলে নেওয়া হয়নি?

“আমরা একক সত্তা হিসেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যেই প্রস্তাব করুক না কেন, পরবর্তী সিদ্ধান্ত হয় একক সত্তার সিদ্ধান্ত। কমিশনের সিদ্ধান্ত, কোনো একজন ব্যক্তির নয়।”

মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যে ইসির প্রতি জনআস্থার সঙ্কট বাড়বে বলে মনে করেন কি না- প্রশ্ন করলে রফিকুল বলেন, “আমি কিন্তু এখনও জানি না, কেন প্রশ্ন তুলছেন। এটাতে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবে। ”

রফিকুল বলেন, মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যে ‘সাংঘর্ষিক’ কথাও বলেছেন।

“একদিকে তিনি বলছেন কমিশনকে শক্তিশালী চাই, একক সত্তা হিসেবে কাজ করতে হবে। এখন নিজের কথা বলছেন। সাংঘর্ষিক কথা বলে নিজের সত্তার অস্তিত্ত্বেই আঘাত করছেন তিনি।”

রিটার্নিং কর্মকর্তা বাধ্য নন: ইসি সচিব

ইসি সচিবালয় রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের অভিযোগের কড়া জবাব দেন ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব আলমগীর।

মাহবুব তালুকদারের অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে ইসি সচিব সাংবাদিকদের বলেন, “রিটার্নিং কর্মকর্তারা তথ্য দিতে বাধ্য। তবে তারা কমিশনকে জানাবে। যেহেতু কমিশনের বিষয়, সেহেতু সিইসির কাছে আগে তথ্য জানাতে হবে।

“তবে সরাসরি কাউকে উত্তর দিতে পারবেন না। তিনি একজন কমিশনারের কাছে তথ্য দিতে বাধ্য না। দিলে পাঁচজনের কাছে দিতে হবে।”

এর আগেও মাহবুব তালুকদারের তোলা বিভিন্ন প্রশ্নে ইসি সচিব আলমগীরের পক্ষ থেকেই জবাব এসেছিল।

কোনো দলের নই: মাহবুব

ইসিতে মাহবুব তালুকদারের ভিন্নমত পোষণকে এতদিন ‘গণতন্ত্রের সৌন্দর্য’ বলে আসছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কিন্তু এখন ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সেই অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে।

মাহবুব তালুকদার সাম্প্রতিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বিএনপির স্বার্থ রক্ষা করছেন বলে এখন দাবি করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, অভিযোগ তোলার আগে তার পদত্যাগ করাই শ্রেয়।

লিখিত বক্তব্য উপস্থাপনের পর এনিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে উত্তর দেন সাবেক আমলা ও কথাসাহিত্যিক মাহবুব তালুকদার।

তিনি বলেন, “যে কেউ যে কোনো কিছু বলতে পারেন। যে কোনো তকমা আমার পেছনে লাগানো যেতে পারে।

“কিন্তু আমার অতীত ইতিহাস যারা জানেন, তারা কখনই বলবেন না যে আমি কোনো নির্দিষ্ট দলের। আর আমি যে মুহূর্ত থেকে এ চেয়ারে বসেছি, সে ক্ষণ থেকে আমি কোনো দলের নই।”

এসব কথা পদত্যাগ করে বলুন, মাহবুব তালুকদারকে তথ্যমন্ত্রী  

কোনো দলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই বলেও দাবি করেন এই নির্বাচন কমিশনার।

“আমার সঙ্গে কোনো মতবাদের সম্পর্ক নেই। আমি আমার বিবেক দ্বারা পরিচালিত। যারা আমাকে নিয়ে কোনো আমার মধ্যে রঙ ধরাতে চান বা আমার মধ্যে দেখতে চান- এটা তাদের রাজনৈতিক একটা বিষয় হতে পারে। কিন্তু আমি এর বিরুদ্ধে।”

Pin It