ঢাকা ওয়াসার পানি শতভাগ বিশুদ্ধ এবং প্রতিটি ফোঁটাই সুপেয়- এমন দাবি করলেও ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন রাজধানীর ৫৯টি এলাকার পানি বেশি দূষিত। এলাকাগুলোর নাম উল্লেখ করে এমডির স্বাক্ষরযুক্ত প্রতিবেদনটি গত ১৩ মে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জমা দেয় ওয়াসা। গতকাল বৃহস্পতিবার সেটা আদালতে উপস্থাপন করে মন্ত্রণালয়। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ওয়াসার পানির মান নিয়ে নগরবাসীর যে অভিযোগ ছিল, তা মেনে নিল ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। এর মধ্য দিয়ে যেন বোধোদয় হলো ওয়াসা এমডির।
সম্প্রতি ওয়াসার পানি দিয়ে শরবত বানিয়ে ঢাকা ওয়াসার এমডিকে খাওয়াতে গিয়ে আলোচনায় আসা জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, কেবল ৫৯টি এলাকার পানির মানই যে খারাপ তা নয়, ঢাকা শহরের প্রায় সব এলাকার পানির মানই খারাপ। ওয়াসার এমডি এতদিন যা বলেছেন, তার শাস্তি কী। তাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে এবং এমডির পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে।
তিনি বলেন, নিরাপদ পানির জন্য আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় জুরাইনের বাসিন্দারা পদযাত্রার আয়োজন করেছেন। জুরাইন মিষ্টির দোকান থেকে শুরু হয়ে শনিরআখড়া পর্যন্ত দুই কিলোমিটার পর্যন্ত এই পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। এ কর্মসূচিতে তিনি ভুক্তভোগী নগরবাসীর যোগদানের অনুরোধ জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যালস কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল মজিদ বলেন, পানি পরীক্ষা একবার করলেই যে হয়ে গেল তা নয়। এটা নিয়মিত করতে হয়। আর ৫৯টি এলাকা কেন, সব এলাকার পানিতেই সমস্যা আছে। এ জন্য ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডের বিভিন্ন স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করতে হবে। পানিতে কোনো জীবাণু আছে কি-না; ক্লোরিন, আয়রন, ধাতু, সিসা, আর্সেনিকের কী পরিমাণ অস্তিত্ব আছে সেগুলোও পরীক্ষা করতে হবে। এসব পরীক্ষায় যদি দেখা যায়, পানি সুপেয় তাহলেই বলা যাবে ওয়াসার পানির মান ভালো।
গত তিন মাসে ওয়াসার কল সেন্টার ১৬১৬২ নম্বরে যেসব গ্রাহক অভিযোগ করেছেন, সেসব এলাকার নামই আদালতে উপস্থাপন করা তালিকায় এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত তিন মাসে ২৯২ জন গ্রাহকের অভিযোগের ভিত্তিতে ঢাকার ১০টি জোনের ৫৯টি এলাকার পানি সবচেয়ে দূষিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো- ১ নম্বর জোনের যাত্রাবাড়ী, বাসাবো, মুগদা, রাজারবাগ, কুসুমবাগ, জুরাইন, মানিকনগর, মান্ডা, দোলাইরপার ও মাতুয়াইল; ২ নম্বর জোনের ভাগলপুর, লালবাগ, বকশিবাজার ও শহীদনগর; ৩ নম্বর জোনের জিগাতলা, ধানমণ্ডি, শুক্রাবাদ, কলাবাগান, ভূতের গলি ও মোহাম্মদপুর; ৪ নম্বর জোনের শেওড়াপাড়া, পীরেরবাগ, মনিপুর, পাইকপাড়া, কাজীপাড়া ও মিরপুর; ৫ নম্বর জোনের মহাখালী ও তেজগাঁও; ৬ নম্বর জোনের সিদ্ধেশ্বরী, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও, মগবাজার, নয়াটোলা, রামপুরা, মালিবাগ ও পরিবাগ; ৭ নম্বর জোনের কদমতলী, দনিয়া, শ্যামপুর, রসুলবাগ, মেরাজনগর, পাটেরবাগ, শনিরআখড়া, কোনাপাড়া ও মুসলিমনগর; ৮ নম্বর জোনের বাড্ডা, আফতাবনগর, বসুন্ধরা ও ভাটারা; ৯ নম্বর জোনের উত্তরা, খিলক্ষেত, সায়েদাবাদ, মোল্লারটেক ও রানাগোলা; ১০ নম্বর জোনের কাফরুল, কাজীপাড়া, মিরপুর, কচুক্ষেত ও পল্লবী। এসব এলাকার পানি এখনও পরীক্ষা করা হয়নি। এ জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রায় পৌনে এক কোটি টাকা দাবি করা হয়েছে।
বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলম সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে গতকাল ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন। পরে প্রতিবেদনে উল্লিখিত দূষিত পানির নমুনা পরীক্ষার বিষয়ে মতামত জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সাবিতা রিজওয়ানা রহমানকে আগামী ২১ মে সকাল সাড়ে ১০টায় হাইকোর্টে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হয়েছে।
হাইকোর্টের আদেশে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি তাদের প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে- ওয়াসার ১০টি জোনের প্রতিটি এলাকা থেকে ৩৫৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হবে। এতে মোট নমুনার সংখ্যা দাঁড়াবে এক হাজার ৬৫টি। এসব নমুনা তিনটি ল্যাবরেটরিতে রোগজীবাণু ও ভৌত রাসায়নিক সংক্রান্ত পরীক্ষা করতে খরচ হবে ৭৫ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ টাকা।
আদালতে স্থানীয় সরকারের পক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। রিটকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তানভীর আহমেদ। অন্যদিকে ঢাকা ওয়াসার পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এম মাসুম।
শুনানিতে তানভীর আহমেদ বলেন, সম্প্রতি ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান তাদের পানি শতভাগ সুপেয় বলে দাবি করেছেন। এখন আদালতে দাখিল করা তার স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে ৫৯টি এলাকার পানি বেশি দূষিত। এতে প্রতীয়মান হয় এমডির বক্তব্য স্ববিরোধী। এর আগে তার বক্তব্য নিয়ে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। এ সময় ওয়াসার এমডি যাতে আর বিভ্রান্তিকর বক্তব্য গণমাধ্যমে না দেন সে বিষয়ে আদালতের নিষেধাজ্ঞা চান তানভীর আহমেদ। তখন আদালত বলেন, ‘এমডির যে বক্তব্য তার জন্য কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে এর দায়দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।’
আদেশের পর রিটকারী তানভীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, পানি পরীক্ষার জন্য ৭৫ লাখ টাকা খরচ হবে বলে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে আদালত বিশেষজ্ঞ (এক্সপার্ট) মতামত গ্রহণ করার কথা জানিয়েছেন, যাতে খরচ আরও কমানো যায়। এ জন্য হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত কমিটির সদস্যদের মধ্য থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাবিতা রিজওয়ানা রহমানকে ২১ মে আদালতে আসতে বলা হয়েছে।
ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে ব্যাকটেরিয়াসহ নানা ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে উল্লেখ করে গত বছর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে একই বছরের ১৪ অক্টোবর হাইকোর্টে জনস্বার্থে রিটটি করেন আইনজীবী তানভীর হোসেন। ওই রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত ৬ নভেম্বর রুল জারির পাশাপাশি ঢাকা ওয়াসার পানি পরীক্ষার জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের আদেশ দেন। রুলে নিরাপদ পানি সরবরাহে কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও নিষ্ফ্ক্রিয়তাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। চার সপ্তাহের মধ্যে স্থানীয় সরকার সচিব, স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ওয়াসার এমডিসহ রিটে উল্লিখিত আট বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল। পরে হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করে গত ১৮ এপ্রিল একটি কমিটি গঠন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল হাইকোর্টে ওই কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার পর বিশ্নেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করতে একটি তহবিলের পাশাপাশি ল্যাবরেটরিসহ ঢাকা ওয়াসার সামগ্রিক প্রচেষ্টা দরকার। এসব কাজের জন্য তহবিল গঠন এবং বিরতিহীনভাবে ওয়াসার তিনটি ল্যাবরেটরিতে একযোগে কাজ করলেও এ প্রতিবেদন তৈরি করতে কমপক্ষে চার মাস সময় প্রয়োজন।’
নগরবাসীসহ সংশ্নিষ্টদের অভিযোগ- ঢাকা ওয়াসা যে পানি সরবরাহ করে তাকে মোটেই সুপেয় বলা যায় না। এমনকি ওয়াসা যে গভীর নলকূপের পানি নগরীতে সরবরাহ করে, সেই পানিও সবক্ষেত্রে শোধন করে না। গভীর নলকূপ থেকেও জীবাণুযুক্ত পানি উত্তোলিত হতে পারে। এ জন্যই গভীর নলকূপের পানি ক্লোরিন মিশিয়ে শোধন করে সরবরাহ লাইনে দেওয়ার কথা। ওয়াসার অনেক পাম্পেই ক্লোরিনের ব্যবস্থা (সেটআপ) নেই। থাকলেও ঠিকমতো ক্লোরিন সরবরাহ না করে ওই অর্থ আত্মসাৎ করেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। এছাড়া যে সরবরাহ লাইন নিয়ে পানি গ্রাহকের ট্যাপে পৌঁছে, সেই লাইনেও অসংখ্য ছিদ্র রয়েছে। ওই ছিদ্র দিয়ে ময়লা-আবর্জনা পাইপে ঢুকে পড়ে। এছাড়া সায়েদাবাদ এবং চাঁদনীঘাট পানি শোধনাগারে শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীর পানি শোধন করে পাইপলাইনে দেওয়া হয়। শুস্ক মৌসুমে দুটি নদীর পানির মানই অতি নিম্ন ও বিষাক্ত হয়ে পড়ে। চ্যানেল দিয়ে মলমূত্রসহ নানা আবর্জনা মিশ্রিত পানি শোধনাগারে প্রবেশ করে। আর ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার উপকরণ মলমূত্র। ওই পানি শোধনের সময় মাত্রাতিরিক্ত ক্লোরিন, লাইম (চুন) ও অ্যালাম (ফিটকিরি) ব্যবহার করা হয়। ফলে শোধনের পরও অনেক সময় পানিতে জীবাণু থেকে যায়। অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে পানিতে গন্ধও পাওয়া যায়। ওই পানি স্বাস্থ্যের জন্য আরও ক্ষতিকর। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে স্যুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে ওয়াসার পাইপলাইনেরও সংযোগ ঘটে যায়।
সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার পানি দূষিত হওয়ার কারণে ৯৩ ভাগ গ্রাহক তা ফুটিয়ে পান করেন। এ জন্য বছরে ৩৩৪ কোটি টাকার গ্যাস পোড়াতে হয়। তারপরই ঢাকা ওয়াসার এমডি সংবাদ সম্মেলন করে টিআইবির প্রতিবেদনকে ভিত্তিহীন উল্লেখ করে ওয়াসার পানি শতভাগ বিশুদ্ধ দাবি করেন। এরপর ঘটে শরবত কাণ্ড।
এর আগে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাইপলাইনের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে যে পানি সরবরাহ করা হয়, তার প্রায় ৮২ শতাংশ পানিতে ই-কোলাইয়ের জীবাণু মিলেছে। ৩৮ শতাংশ গভীর নলকূপের পানিতেও পাওয়া গেছে ই-কোলাই জীবাণু ও আর্সেনিক। পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহের জন্য ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়াকে দায়ী করা হয়।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) হাসপাতাল বিভাগের প্রধান ডা. আজহারুল ইসলাম বলেন, দূষিত পানির কারণে হেপাটাইটিস, ডায়রিয়া, কলেরা, টায়ফয়েড, আমাশয়, কিডনি, আলসার, রক্তচাপ, অ্যাজমা, জন্ডিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে মানুষ। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে না পারলে নগরবাসীর স্বাস্থ্যকে হুমকিমুক্ত করা যাবে না।