সম্প্রতি বিএনপির দুজন সিনিয়র নেতা এবং সিলেট জেলার বিএনপির পাঁচজন প্রভাবশালী নেতা পদত্যাগ করেছেন। যদিও দলটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান এবং ভাইস চেয়ারম্যান মোরশেদ খানের পদত্যাগের বিষয়টি তারা জানেন না।
আর সিলেটের মেয়র ও দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আরিফুল হকসহ পাঁচজনের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়নি। তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্ব, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও জামায়াতকে নিয়ে জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতি করার কারণেই এসব নেতা পদত্যাগ করেছেন বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে।
বিএনপির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, দলে নিজের একক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ায় তারেক রহমানের ওপরে বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতা ক্ষুব্ধ। তবে এ বিষয়ে কেউ সরাসরি কথা না বললেও নীরব প্রতিবাদ হিসেবে দল থেকে পদত্যাগ করছেন। আর তারা দল থেকে পদত্যাগ করে মূলত বিএনপি হাই কমান্ডের সিদ্ধান্তকে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সিনিয়র নেতারা পদত্যাগ করছেন, সেটা আমরা আপনাদের কাছে জানতে পারছি। আমি এখনো জানি না।’
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘পদত্যাগ মানে কি পার্টি ছেড়ে দেওয়া? সরকারের জুলুম-নির্যাতন থেকে নিজেকে সেভ রাখার জন্যও তো হতে পারে। আবার যখন মনে করবে তখন তারা দলে চলে আসবেন।’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘এটার প্রশ্নই আসে না। কারণ বিএনপিতে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান অপরিহার্য। আর প্রত্যাশা পূরণ না হলে এবং অভিমান করে অনেকেই চলে যান। কিন্তু যখন নিজের ভুল ধরতে পারেন তখন আবার চলে আসেন।’
এদিকে গত মঙ্গলবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছিল। ওই বৈঠকে তারেক রহমান স্কাইপে যুক্ত হবেন হবেন বলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বৈঠকে যেতে অস্বীকৃতি জানান। তাদের ভাষ্য, তারেক জিয়া যেসব নির্দেশনা দেন, তা মেনে নেয়া অসম্ভব। আর এ কারণে গত কয়েকদিন ধরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, আমির খসরু মাহমুদ এবং সেলিমা রহমান ছাড়া দলটির অন্যান্য স্থায়ী কমিটির সদস্যরা তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলছেন না বলে দলটির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি একেবারেই আদালতের এখতিয়ার। এ বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি একেবারেই আদালতের এখতিয়ার। আদালত তাকে বয়স বিবেচনায় খালাস দেবেন, নাকি দেবেন না, এটি একান্ত আদালতের ব্যাপার। তবে, এখানে দুর্নীতির সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আপস করার অথবা বিএনপির আবদার রক্ষা করার কোনও সুযোগ নেই।
সূত্রটি আরও জানায়, গত ১০ নভেম্বর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে তারেক রহমান কথা বলেছেন। ওই সময় তারেক রহমান মির্জা ফখরুলকে বলেন, চিকিৎসার জন্য বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য প্যারোলের আবেদন করা দরকার। তবে বেগম জিয়াকে প্যারোলে মুক্ত করা হলে সেই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হবে বলে মনে করছেন বিএনপির অধিকাংশ নেতা।
তবে বেগম খালেদা জিয়া সর্বশেষ বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতে বলেছেন, তিনি প্যারোল চান না। কারণ জামিন তার অধিকার।
অপরদিকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে নজরদারিতে রেখেছে বিএনপি। তারেক রহমান তার সকল কার্যক্রম নজরদারি করার জন্য বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। সে নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে বরিশাল অঞ্চলের প্রভাবশালী এক যুব নেতার নেতৃত্বে একটি বিশেষ টিম আলতাফ হোসেনের সকল কার্যক্রম মনিটরিং করছে বলে ওই সূত্রে জানা গেছে।
সূত্রটি জানায়, সম্প্রতি আলতাফ হোসেন চৌধুরীর বাসায় দল ত্যাগে ইচ্ছুক কিছু সিনিয়র নেতাদের গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকেই বেশ কয়েকজন নেতা নিজেদের অবমূল্যায়ন এবং তারেক রহমানের খবরদারির বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করেন।
সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, আব্দুল্লাহ আল নোমান, আব্দুল আউয়াল মিন্টুসহ একাধিক সিনিয়র নেতা।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে আলতাফ হোসেন ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করার বিষয়ে আলোচনা করেন। পরবর্তীতে তিনি নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়েও বৈঠকে ইঙ্গিত দেন নেতাদেরকে।
কোন পথে খালেদা জিয়ার মুক্তি?
রাজপথের আন্দোলন এবং আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। তবুও দলটি বলছে, রাজপথের আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই তারা তাদের নেত্রীকে কারাগার থেকে মুক্ত করবে। তবে বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কারণে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে চান তার স্বজনরা। কিন্তু প্যারোলে নাকি জামিন, কোন প্রক্রিয়ার মুক্তি পেয়ে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন বিদেশে যাবেন? এ বিষয়টি এখন রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা চলছে। যদিও বিএনপির সংসদ সদস্যরা এবং বেগম জিয়ার স্বজনরা দুই প্রক্রিয়াতেই বেগম জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে রাজি আছেন। তবে বেগম জিয়া বিদেশে যান, সেটা বিএনপির একটি গ্রুপ চান না। কিন্তু বেগম জিয়া প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশে চিকিৎসা নেবেন- তা তারেক রহমান চান বলে দলটির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘সরকার যদি চায় তাহলেই তো তিনি বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন। তবে এ বিষয়ে খালেদা জিয়া আমাদের সঙ্গে কিছু বলেননি। আমরাই বিদেশে পাঠাতে চাচ্ছি। কারণ এখানে (বিএসএমএমইউ) তো যে চিকিৎসা দিচ্ছে, এতে কিছুই হচ্ছে না। বরং দিনের দিন খারাপ হচ্ছে।’
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আমাদের কারও কাছে দেন-দরবার করার দরকার নাই। বেগম জিয়াকে জামিন দেবে না, কারণ সরকার চায় না। সেজন্য জামিন হচ্ছে না। আমরা বলতে চাই, আইনের মাধ্যমেই তার জামিন হবে, না হয় রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে তার মুক্তি হবে।’
অপরদিকে গত ১ ও ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন দলটির সংসদ সদস্যরা। ওই সময় দলটির সাংসদরা খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন নিয়ে বিএনপিতে দ্বন্দ্ব
বিএনপির সিনিয়র নেতারা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে নিয়ে আর এক সঙ্গে পথ চলতে চান না। কিন্তু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঐক্যফ্রন্ট ভেঙে দিতে চান না। তিনি সুযোগ বুঝে ঐক্যফ্রন্ট কাজে লাগাতে চান। তবে এ বিষয়ে বিএনপির নেতাদের ভাষ্য, ঐক্যফ্রন্ট করে বিএনপির কোন লাভ হয়নি, বরং ক্ষতি হয়েছে। আর বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে যদি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা অনীহা প্রকাশ করেন তাহলে তো তাদের সঙ্গে দীর্ঘ পথ চলা ক্ষতিকর।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আছে, তাদেরকে সম্মান করি ও গুরুত্ব দেই। কিন্তু তারা যদি আমাদের ঘাড়ে চেপে তাদের নিজস্ব টার্গেট নিয়ে চলতে চায়, সেই পথে চলাতো আমাদের জন্য বোকামি হবে। খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য তাদেরকে কেনো মঞ্চে চিরকুট দিতে হবে? বেগম জিয়ার মুক্তির কথা তারা কেনো বলতে পারবে না? আর যার বিরুদ্ধে আমরা রাজনীতি করি তাদের কথা জোরেশোরে আমাদের সামনে কেনো বলা…। তারপরও আমরা সহ্য করি কেনো? শুধুমাত্র করি- জাতীয় ও জনগণের স্বার্থে। এ কারণে আমি মনে করি, সবাইকে একটু সতর্ক হওয়া ভালো।’