দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত ও লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার নাম নিতেও ঘৃণা লাগে। তবে তাকে ফিরিয়ে আনতে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। আজ হোক, কাল হোক- তার শাস্তি কার্যকর হবেই।
জঙ্গিবাদ নির্মূলে আবারও দলমত নির্বিশেষে দেশবাসীর সহযোগিতা চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের জনগণকে সম্পৃক্ত করেই এটি মোকাবেলা করতে চান তিনি। জঙ্গিবাদ দমনে জনগণের সচেতনতাই সবচেয়ে বড় শক্তি। তাই জনগণকে আরও সচেতন হতে হবে, সজাগ থাকতে হবে। দেশ আজ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। জনগণের সম্মিলিত শক্তিতেই এই উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে এগিয়ে যেতে চান তিনি।
মিয়ানমারের আপত্তি ও অসহযোগিতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হচ্ছে না জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, সবাই চায় রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত যাক। তবে মিয়ানমারের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে নেপিদো আগ্রহী নয়।
রোববার গণভবনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত সব ইস্যুর সমাধানেও আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদি আবারও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। তাকে অভিনন্দন জানাই। আশা করি, কেবল তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে সব সমস্যাই একে একে সমাধান হবে।’
প্রধানমন্ত্রী তার সদ্যসমাপ্ত জাপান, সৌদি আরব ও ফিনল্যান্ড সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতেই এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। তবে সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে দেশের সমসাময়িক রাজনীতি, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে। প্রধানমন্ত্রীও বিভিন্ন প্রশ্নের খোলামেলা জবাব দিয়েছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে শেখ হাসিনা তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কখনও হাস্যরসাত্মক, কখনও তির্যক মন্তব্যও করেন।
সংবাদ সম্মেলন মঞ্চে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আরও ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক ও কর্মাধ্যক্ষ এবং জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা ছাড়াও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা এবং সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
‘তারেককে ফেরাতে আলোচনা চলছে’: তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘(তার জন্য) দরদ একেবারে উথলে ওঠে। সবাই এটা ভুলে যান কীভাবে? একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথা? কীভাবে আমরা বেঁচে গেছি! বাঁচারই তো কথা না, আইভি রহমান মারা গেলেন। এতগুলো মানুষের জীবন তারা নিল ক্ষমতায় থাকতে। একবার না, বারবার– বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে বা বাইরে থাকতে বারবার আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে!’
তিনি বলেন, ‘হত্যাকারী তারপর আবার এতিমের হক আত্মসাৎকারী এবং দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাকারবারি– এদের জন্য অনেকেরই মায়াকান্না। তাহলে এ দেশে অপরাধীর বিচার হবে কীভাবে? সেটাই প্রশ্ন। আমরা আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে। তবে এরা এত বেশি টাকাপয়সা বানিয়ে ফেলেছে যে, সেখানে খুব বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। আর যখনই যাই তখনই একটা সমস্যা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। আজ হোক, কাল হোক, এক সময় শাস্তি কার্যকর হবেই।
‘ঈদে জঙ্গি হুমকি ছিল’: এবার ঈদ জামাতের সময় জঙ্গি হামলার হুমকি ছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঈদের জামাতের সময় তিনি সত্যিই খুব চিন্তিত ছিলেন। তবে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আন্তরিক চেষ্টায় কোনো অঘটন ছাড়াই সুষ্ঠুভাবে ঈদ সম্পন্ন হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘গুলশানের হলি আর্টিসানে ২০১৬ সালের জঙ্গি হামলার পর থেকেই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ও পুলিশ কড়া নজরদারি শুরু করে। কোথাও কোনো ধরনের তথ্য পেলেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপরও নানা নামে, নানাভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নানা ধরনের থ্রেট কিন্তু দিতেই থাকে। সারাক্ষণ এগুলো আসছে। সবটা বলে মানুষকে ভীত করতে চাই না। এগুলোর পেছনে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তদন্ত করে এবং তাদের বিরুদ্ধে যা যা ব্যবস্থা নেওয়ার তা নেওয়া হয়ে থাকে।’
ধর্মের নামে বিভ্রান্ত করে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কে ভালো মুসলিম, কে না; কে সঠিক, কে সঠিক না; কে ভালো কাজ করছে, কে করছে না– সেটা বিচার করার দায়িত্ব আল্লাহ আমাদের দেননি। কেন মানুষ আল্লাহর ক্ষমতা কেড়ে নেবে? শেষ বিচার তো তিনি করবেন। মানুষ মারলেই একেবারে বেহেশতে চলে যাবে, এটা তো কোনোদিন হয় না। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এত নিউজ দেয়, এত আইটেম দেয়, এমন তো কেউ দেয় না যে, মানুষ খুন করে বেহেশতে গিয়েছে। আর বেহেশতে গিয়ে তারা তো একটা মেসেজও দিতে পারেনি। তারা যদি মেসেজ পাঠাত, তখন না হয় বুঝতাম।’
‘ফরমায়েশি লেখা পাচ্ছেন না বলে লিখতে পারছেন না’: জার্মানভিত্তিক বার্তা সংস্থা ‘ডয়েচে ভেলে’র সঙ্গে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের বক্তব্যের সমালোচনাও করেন প্রধানমন্ত্রী। এক প্রশ্নের জবাবে তার নাম উল্লেখ না করেই শেখ হাসিনা বলেন, তিনি বলেছেন তিনি নাকি লিখতে পারছেন না। আসলে তিনি ফরমায়েশি লেখা পাচ্ছেন না বলে লিখতে পারছেন না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যদি সত্যিই এ রকম অবস্থা হতো তিনি কি এই কথাটুকুও বলার সাহস পেতেন যে, তিনি লিখতে পারছেন না? কেউ তো চাপ দেয়নি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থাকলে তাদের ভালো লাগে না। তাদের ভালো লাগে যদি কোনো অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থাকে। যেমন ইমার্জেন্সি সরকার হোক বা মিলিটারি সরকার হোক, এ রকম কিছু হলে তখন তারা ফরমায়েশি লেখা লিখতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তার এই কথা থেকে আমার মনে হয়, একবার টেলিভিশনের টক শোতে কয়েকটা মিথ্যা নিউজ নিয়ে তাকে ধরেছিল কেউ। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কী করব, আমাকে ডিজিএফআই যেটা সাপ্লাই দিয়েছে আমি সেটাই ছাপিয়ে দিয়েছি। লিখে দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আপনি ওই কথাটার সঙ্গে এই কথাটার লিঙ্ক করেন। কারণ এখন ডিজিএফআই তাকে কোনো লেখা দিচ্ছে না। কাজেই তিনি লিখতে পারছেন না। আমি তো এটাই বুঝব।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি সবসময় মনে করি, আমার বিবেক যদি ঠিক থাকে। আমি সঠিক থাকলে কে কী লিখল তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি আমার দেশকে ভালোবাসি, দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আমি যা কাজ করি দেশের জনগণের কল্যাণে করি। এই বিশ্বাসটা যদি আমার থাকে তাহলে কে কোনটা ভালো বলল, কোনটা মন্দ বলল এটা নিয়ে আমার মাথাব্যথার কিছু নেই।’
বিমান প্রসঙ্গ: সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে একজন পাইলটের পাসপোর্ট ছাড়াই কাতার যাওয়া সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, যখনই বিমানে উঠি তখনই একটা ঘটনা ঘটে। একটা নিউজ হয়, নিউজটা কেন হয় জানি না। হয়তো পাসপোর্ট নিতে ভুলে যেতে পারে। ভোলা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু এখানে ইমিগ্রেশনে যারা ছিল, তাদের তো এ নজরটা থাকতে হবে।
তার (প্রধানমন্ত্রী) কাছে খবর যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেছেন, অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে। ইমিগ্রেশনে কারা ছিল? কেন চেক করেননি? কেন দেখেননি। এ প্রসঙ্গে ইমিগ্রেশনে চেকিং কঠোর করা এবং ভিভিআইপিসহ সবাইকে এর আওতায় আনার নির্দেশের কথাও জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যখনই আমি যাই তখনই একটা ঘটনা। আমার কাছে শত শত মেইল যাচ্ছে। আপনি আইসেন না, বিমান আসবে না। আমি বললাম, বিমান আসবে না মানে? বলে না এটা হয়েছে। আমি বললাম, যা হয় হোক। মরলে নিজের প্লেনেই তো মরব। নিজের প্লেনে মরলে মনে করব নিজের মাটিতেই মরলাম। আমি আমার বিমানেই যাব। আমি অন্য কোনো এয়ারলাইন্সে যাব না।’
জুলাইয়ে চীন সফর: প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাপান সফর যেমন সফল হয়েছে, তেমনি চীনেও হবে। এরই মধ্যে তার দাওয়াত ছিল। কিন্তু সে সময় জাতীয় সংসদের জরুরি কিছু বিষয় থাকায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। আগামী জুলাই মাসে আবারও দাওয়াত দিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট। ৩০ জুন বাজেট পাস হওয়ার পর সেখানে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সামার সামিট হবে। তারিখটা ঠিক হলে সেখানে যাবেন তিনি।
‘মুসলিম বিশ্বে খুনোখুনিতে লাভবান অস্ত্র বিক্রেতারাই’: মুসলিম দেশগুলোতে সহিংসতা ও রক্তপাতের অবসানে ওআইসিকে আরও উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই যে আত্মঘাতী সংঘাত করে যাচ্ছি, একে অপরকে খুন করছি, রণক্ষেত্র হচ্ছে সব মুসলিম দেশ। প্রতিটি মুসলিম দেশের মধ্যেই খুনোখুনি হচ্ছে। লাভবান কে হচ্ছে? যারা অস্ত্র সরবরাহ করছে, যারা অস্ত্র তৈরি করছে আর যারা বিক্রি করছে তারাই লাভবান হচ্ছে। আর মুসলমান মুসলমানের রক্ত নিচ্ছে।
এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার তাগাদা সৌদি আরবের মক্কায় ওআইসি সম্মেলনে দিয়ে এসেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে যদি কোনো দ্বন্দ্ব থাকে, সেটা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা দরকার। ওআইসিরও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া দরকার।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেটা বাস্তব সেটাই বললাম। কারণ একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ছাড়া কারও কাছে আমরা মাথা নত করব না। আমার বাবাও করেননি, আমিও করব না। ওটা আমরা শিখিনি।’
১১ দিনের বিদেশ সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৮ মে জাপানে যান। জাপানের রাজধানী টোকিওতে ‘দ্য ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন তিনি। সেখানে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য জাপানের সঙ্গে ২৫০ কোটি ডলারের উন্নয়ন সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। জাপান সফর শেষে ওআইসির চতুর্দশ সম্মেলনে যোগ দিতে ৩০ মে শেখ হাসিনা সৌদি আরব যান। ওই সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পর ওমরাহ পালন করেন তিনি, জিয়ারত করেন মহানবীর (সা.) রওজা। এর পর ৩ জুন যান ফিনল্যান্ডে। সেখান থেকে শনিবার দেশে ফেরেন প্রধানমন্ত্রী।