রাজধানীসহ দেশজুড়ে ডেঙ্গু জ্বর ভয়াবহ আকার ধারণ করায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা নির্মূলে বিদ্যমান ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে যৌথ অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি তারিক-উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ারদী সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এর আগে এদিন সকালে হাইকোর্টের এই বেঞ্চে হাজিরা দেন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। গত ২২ জুলাই এই দুই স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে মশা নির্মূলে তাদের কার্যক্রম সর্ম্পকে জানাতে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
আদালতে উত্তর সিটি করপোরেশনে পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তৌফিক ইনাম টিপু ও দক্ষিণের পক্ষে আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সায়রা ফাইরোজ।
বৃহস্পতিবার শুনানির শুরুতে ঢাকা দক্ষিণের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শরীফ আহমেদ বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এক কোটির বেশি লোক। আর ১০টি জোনে ৭৫টি ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রমে জনবল মাত্র ৪২৯ জন। তখন আদালত জানতে চান– এ বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এত কেন। এ পর্যায়ে শরীফ আহমদ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব, আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, এটা একটা বৈশ্বিক সমস্যা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এমনটা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এর ভয়াবহ প্রভাব চলছে। তখন হাইকোর্ট বলেন, ‘ওষুধ কার্যকর হচ্ছে না কেন? গত বছর ওষুধ ছিটালে ঘরেও তার ঝাঁঝ পেতাম। এবার গন্ধও পাওয়া যায় না। জনগণের ধারণা হচ্ছে– এবারের ওষুধে কাজ হচ্ছে না। টিভিতে দেখলাম, সড়কমন্ত্রী বলেছেন, এবারের ওষুধ কাজ করছে না। এর আগে তো কেউ স্বীকারই করেনি।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রি. জেনারেল (ডা.) মো. শরীফ আহমেদ বলেন, ওষুধ আনার পর সরকারি দুটি ল্যাবে পরীক্ষা করে ‘পজিটিভ সার্টিফিকেট’ পেলেই ব্যবহার করা হয়। তখন হাইকোর্ট বলেন, যখন দেখলেন ওষুধ কাজ করছে না, তখন অন্য জায়গায় দ্রত টেস্ট করবেন না? এসব কি আমাদের বলে দিতে হবে? অবস্থা যেরকম যাচ্ছে– এটা কেবল সিটি করপোরেশনের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না। বিষয়টা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেও দেখতে হবে।’
এরপর ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোমিনুর বলেন, ‘আমরা পুরো ওষুধটাই পরিবর্তন করবো। এজন্য একটি কারিগরি কমিটি করা হয়েছে। এ সময় এডিস মশা নির্মূলে এক সপ্তাহের মধ্যে কার্যকর ওষুধ আনার প্রক্রিয়া জানতে চেয়ে হাইকোর্ট বলেন, ‘সারা দেশের মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত। ঘরে ঘরে মানুষ আক্রান্ত। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা নির্মূলে এক সপ্তাহের মধ্যে কার্যকর ওষুধ আনবেন। কীভাবে আনবেন, সেই প্রক্রিয়া বলুন।’
আদালত আরও বলেন, ‘অনেকে হাসপাতালে যায় না। সবাই হাসপাতালে গেলে এই সংখ্যা বেশি হতো।’ তখন দুপুর ২টার মধ্যে দুই প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে কার্যকর ওষুধ আনতে কতটা সময় লাগবে সেই তথ্য জানাতে বলা হয়।
পরে দুপুর ২টার দিকে শুনানিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আইনজীবী তৌফিক ইনাম টিপু বলেন, ‘নতুন ওষুধ আনতে এক মাস সময় লাগবে। আগামী চার-পাঁচ দিন আমারা কমবাইন্ডলি (সমন্বিত) অভিযান চালাবো।’
অন্যদিকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ বলেন, ‘বিদ্যমান ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে দিয়ে কার্যকর ফল পাওয়া যেতে পারে। একবারের জায়গায় একাধিকবার ফায়ার ( স্প্রে) করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অবস্থা এমন হয়েছে, রোববার দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় মশা মারার ওষুধ ছিটালে সেই এলাকার মশা উড়ে সোমবার উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় চলে যায়।’ তখন আদালত বলেন, ‘এটা একটা কথা হলো? সদরঘাটের মশা কি তাহলে উড়ে উত্তরা চলে যায়?’
এ পর্যায়ে উষ্মা প্রকাশ করে আদালত বলেন, ‘তিনবার বা পাঁচবার গুলি করুন ( স্প্রে)। কিন্তু আমরা চাই মশা মরুক।’ এ সময় দুই আইনজীবী আদালতকে জানান, আগামী চার দিন ওষুধ ছিটানোর মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে কমবাইন্ডলি মশা নিধন কার্যক্রম চালালে কাজ হতে পারে। এ পর্যায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে হাইকোর্ট বলেন, সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা বলছে মশার ওষুধ কাজ করছে না। অথচ সিটি করপোরেশন বলছে কার্যকর। সরকার বক্তব্য দিচ্ছে একটা, আর সিটি করপোরেশন বক্তব্য দিচ্ছে আরেকটা! তখন আইনজীবীরা নতুন কার্যকর ওষুধ আনতে এক মাস সময় লাগবে বলে আদালতকে জানান। পরে আদালত দুই সিটি করপোরেশনের কর্তৃপক্ষকে এডিস মশা নির্মূলে বিদ্যমান ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে যৌথ অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। এ ছাড়াও সংশ্লিষ্টদের ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে অগ্রগতি জানাতেও নির্দেশ দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বিস্তার নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে গত ১৪ জুলাই হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত রুলসহ আদেশ দেন। রুলে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নাগরিকদের মধ্যে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া এবং মশাবাহিত অন্যান্য রোগের বিস্তার রোধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রুলে এসব রোগ প্রতিরোধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তাও রুলে জানতে চাওয়া হয়। এছাড়াও পরবর্তী শুনানিতে দুই স্বাস্থ্য কর্মর্কতাকেও হাইকোর্টে তলব করা হয়।