চীন তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন ঢাকায় কর্মরত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার যদি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায় তবে, চীন সব ধরনের সহায়তা দেবে। তবে আমরা বুঝতে পারি তিস্তা প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের ওপর বাইরের চাপ আছে। কেন না এই প্রকল্প ভূ-রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর। গতকাল শনিবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে এক সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেস নিয়ে এই সেমিনারের আয়োজন করে বাংলাদেশ-চীন সিল্ক রোড ফোরাম।
এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। বাংলাদেশ-চীন সিল্ক রোড ফোরামের চেয়ারম্যান দিলীপ বড়ুয়া সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন। সেমিনারে চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, বাংলাদেশে পানি সমস্যা সমাধানে তিস্তা প্রকল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমাদেরও অনেক নদী রয়েছে। চীন হাজার বছর ধরে পানি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। তিস্তা প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ সরকার আমাদের প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা গ্রহণ করেছি। এখন এটা নিয়ে সমীক্ষা চলছে।
তিস্তা নদীর উৎসে বাঁধ দিয়ে পানি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করছে চীন, এমন মিডিয়া রিপোর্টের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এর উৎস সিকিমে (ভারতের একটি রাজ্য), চীনে নয়। এটি সম্পূর্ণ বানোয়াট রিপোর্ট। বাংলাদেশ ভাটির দেশ মন্তব্য করে তিনি বলেন, প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি অনুযায়ী সীমান্তের কাছে কোনো ধরনের বাঁধ নির্মাণ করা হবে না এবং বিপরীত স্রোতের কারণে উজানের দেশের জন্য এটি ক্ষতিকর নয়। এই প্রকল্প উজানের দেশের জন্য কোনো ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে না। আমাকে কয়েকজন বলেছে এই প্রকল্পের বিষয়ে যেন আমি সাবধানে থাকি। কারণ এর স্পর্শকাতরতা আছে। বিশেষ করে ভূরাজনৈতিক। তিনি বলেন, অর্থ বা প্রযুক্তি নয়, বরং বাংলাদেশের সরকারের দৃঢ় সংকল্প এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় জিনিস।
এক প্রশ্নের উত্তরে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট একটি আঞ্চলিক ইস্যু। এই সংকটের মধ্যস্থতা করছে চীন। তবে এখানে অনেক পক্ষ জড়িয়ে গেছে। কোনো কোনো পক্ষ গঠনমূলকভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চায় না। আর চীনের প্রধান লক্ষ্যই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। তিনি আরো বলেন, চীন এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার এবং মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করছে। চীন এ বিষয়ে সবাইকে জানিয়ে কাজ করার পক্ষে নয়। চীন নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা চাইব, রোহিঙ্গারা যেন নিরাপদ এবং স্বেচ্ছায় তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যায়। সমস্যার সমাধান দ্বিপাক্ষিকভাবে হওয়া উচিত। যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন শুরু হোক, এটিই চীনের চাওয়া।
রাষ্ট্রদূত বলেন, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) ৯ কোটি ৬০ লাখ সদস্য রয়েছে। এটা বিশ্বের সব চেয়ে বড় পার্টি। এবারের কংগ্রেস এই পার্টির নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করেছে। এই নেতৃত্বে রয়েছেন শি জিন পিং। মার্ক্সবাদকে ভিত্তি করেই চীন এগিয়ে চলেছে। সিপিসি মার্ক্সবাদের মূলভিত্তি ধারণ করে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, বিশ্বে শান্তি বজায় রাখতে আগ্রহী চীন। এই যুদ্ধের ফলে এশিয়ানরাও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। কেন না দ্রব্যমূল্যের ওপর প্রভাব পড়ছে। তবে চীন কোনো যুদ্ধ চায় না। শান্তি চায়।
চীন-বাংলাদেশে বন্ধু এবং গণতন্ত্রের মূল্য দেয় জানিয়ে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, চীন বাংলাদেশের কৌশলগত বন্ধু। বাংলাদেশকে যেকোনো ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত চীন। অতীতেও সহযোগিতা করেছি; ভবিষ্যতেও করবো। চীন গণতন্ত্রকে মূল্য দেয়। তবে শুধু ভোট দেয়াটাই গণতন্ত্র নয়। আমরাও গণতন্ত্র চর্চা করি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে রাষ্ট্রদূতকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমার মত হচ্ছে, উন্নয়নের জন্য শান্তি ও স্থিতিশীলতা দরকার। আমরা আশা করি এদেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে যাতে আর্থ-সামাজিক উন্নতি অব্যাহত থাকে। চীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করবে না। আমরা এখানের সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থিতিশীলতা চাই।
সেমিনারে বিশেষ অতিথি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন বলেন, চীন বর্তমানে তার শক্তি বাড়িয়ে চলছে। তবে চীন কোনো যুদ্ধে জড়াতে চায় না। তারা শান্তি চায়। আর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে জ্বালানি সঙ্কট শুরু হয়েছে। চীন এই যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করে সমাধান চাইছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, চীন প্রধান বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হবে। বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে ভূমিকা রাখবে।