দরপত্রের শর্ত জালিয়াতি করে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সরকারি ‘এসপিএফএমএস’ প্রকল্পে। এজন্য পরপর চার দফা দরপত্রের শর্ত শিথিল করা হয়েছে। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ফাইজা এন্টারপ্রাইজ নামের নতুন একটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতিগ্রস্ত এই প্রতিষ্ঠানটি নিজ স্ত্রীর নামে খুলেছেন একই প্রকল্পে কর্মরত পিওন আলিম উদ্দিন। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
দরপত্রের শর্ত শিথিলের জালিয়াতি দেখে সরকারের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিটিপিইউ) পক্ষ থেকে বলা হয়, এক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে। প্রতিযোগিতা কমিশন বলেছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখে জালিয়াতির প্রমাণ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোকবল নিয়োগের দুর্নীতি দূর করতে গত ফেব্রুয়ারিতে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঠিকাদারদের মধ্যে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে পুরোনো জনবলের পরিবর্তে অবৈধ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে নতুন জনবল নতুনভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এবং নিয়োগপ্রাপ্তদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও নিবিড় মনিটরিংয়ের প্রয়োজন বলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সূত্রমতে, স্ট্রেনদেনিং পাবলিক ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম টু এনাবেল সার্ভিস ডেলিভারি (এসপিএফএমএস) প্রকল্পের ‘আইবাস-এনএস-১ স্কিমে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে চতুর্থ শ্রেণির ১৪ জন কর্মচারী সরবরাহের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। এছাড়া আরও একটি দরপত্র যার নম্বর (০৭.০০.০০০.০৭.০৩৮.১৯.০৪) প্যাকেজ নং-এফডি-এনএস-১ স্কিমে ১৩ জন জনবল নিয়োগের আহ্বান করা হয়।
এসওই-এনএস-২ স্কিমে ৬ জন জনবলের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয় (নম্বর-০৭.০০.০০০০.০০০.০৭.০০৫.২০) এবং এফডিবিপি-এনএস-১ স্কিমে ৬ জন লোক সরবরাহে দরপত্র আহ্বান করা হয় (নম্বর- ০৭.০০.০০০০.০০০.০৭.০১৮.২১.৫০)। এছাড়া একই প্রকল্পে এসওই-এনএস-টি প্যাকেজে ৬ জন জনবল নিয়োগের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয় (নম্বর-০৭.০০.০০০০.০০০.০৭.০০৫.২০) এবং এফডিবিপি-এনএসআই প্যাকেজে আরও ৬ জন লোক সরবরাহে দরপত্র আহ্বান করা হয়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, দরপত্রের শর্তের জায়গায় জামানত এবং অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে লোকবল সরবরাহের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা ও জামানত চাওয়া বাধ্যতামূলক ।
বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সরকারের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) মহাপরিচালক মোহাম্মদ সোহেলার রহমান চৌধুরী বলেন, উল্লিখিত দরপত্র প্রচলিত ‘স্ট্যান্ডার্ড টেন্ডার ডকুমেন্ট (ন্যাশনাল) ফর প্রকিউরমেন্ট অব নন কনসালটিং সার্ভিস (উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি)’ রুলস অনুযায়ী হয়নি। এখানে ব্যত্যয় হয়েছে। কোনো সংস্থা বা বিভাগ এটি করতে পারে না।
স্বাভাবিক দরপত্রের নিয়ম ভেঙে কেন শর্ত শিথিল করা হয়েছে, এর অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, এই চারটি দরপত্রের চাহিদা অনুযায়ী লোকবল সরবরাহের কাজ পেয়েছে ফাইজা এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী হলেন পারুল আক্তার, ঠিকানা-৯৭/৩/খ, উত্তর বিশিল, মিরপুর-১ ঢাকা-১২১৬। কিন্তু এই ঠিকানায় ফাইজা এন্টারপ্রাইজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
আর পারুল আক্তার হচ্ছেন এসপিএফএমএস প্রকল্পের একটি স্কিমে পিওন আলিম উদ্দিনের স্ত্রী। আলিম উদ্দিন নিজেও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ওই প্রকল্পে নিয়োগ পেয়ে কাজ করছেন। পাশাপাশি তার স্ত্রীর নামে ফাইজা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। প্রতিষ্ঠানের বয়স এক বছরও হয়নি, অন্য কোনো স্থানে লোকবল সরবরাহের অভিজ্ঞতাও নেই। যে কারণে এই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে চারটি দরপত্রের শর্ত শিথিল করে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি জানতে ফাইজা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী পারুল আক্তারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে মোবাইল ফোন রিসিভ করেন আলিম উদ্দিন। পারুল আক্তারকে চাইলে আলিম উদ্দিন তার সঙ্গে কথা বলতে বলেন এবং নিজেকে পারুলের স্বামী হিসাবে পরিচয় দেন। পরিচয় পাওয়ার পর তিনি পারুল আক্তারের সঙ্গে কথা বলানোর জন্য একদিন সময় চান।
পরদিন পারুল আক্তার কাছে স্বীকার করেন, তার স্বামী ব্যবসায় বড় ধরনের লোকসানে পড়েন। ব্যবসা ছেড়ে তিনি এখন আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে প্রকল্পে কাজ করছেন। পাশাপাশি তিনি ফাইজা এন্টারপ্রাইজ কোম্পানিটি গঠন করে ব্যবসা করছেন। তিনি বিষয়টি মানবিক দিক থেকে দেখার অনুরোধ করেন। প্রকল্পে চাকরি করে একই প্রতিষ্ঠানে লোকবল সরবরাহের ঠিকাদারি কাজ করা কতটুকু আইনসিদ্ধ জানতে চাইলে কোনো উত্তর দিতে পারেননি আলিম উদ্দিন।
শর্ত শিথিল করে চারটি দরপত্রের মাধ্যমে ফাইজা এন্টারপ্রাইজকে আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেওয়া হয়েছে-বিষটি জানতে চাইলে এসপিএফএমএস প্রকল্পের জাতীয় কর্মসূচি পরিচালক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজমা মোবারক জানান, অভিজ্ঞতা ছাড়া দরপত্র আহ্বান ও লোকবল নিয়োগের বিষয়টি তার জানা নেই। তিনি বলেন, এ বিষয়ে না জেনে আমি কথা বলতে পারব না।
দরপত্র জালিয়াতি বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনে বলা আছে, দরপত্র জালিয়াতি কার্টেলের অংশ। ওই অপরাধের কারণে এই আইনের ২০ ধারায় অর্জিত মুনাফার ৩ গুণ অথবা বিগত ৩ বছরের গড় টার্নওভারের ১০ শতাংশ, যা বেশি সে পরিমাণ প্রশাসনিক আর্থিক জরিমানা আরোপের বিধান আছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুল ইসলাম বলেন, দরপত্র জালিয়াতির ঘটনা দেশে ঘটছে। আইনের মাধ্যমে তার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। এক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোতে স্থায়ী ও অস্থায়ী লোকবল নিয়োগের পাশাপাশি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়। সাধারণত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। অস্থায়ীভাবে চুক্তিতে এই নিয়োগ পান তারা। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এভাবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সেবা গ্রহণ নীতিমালা-২০০৮ প্রণয়ন করা হয়।