বিভ্রান্তি তৈরি করতে দলের মধ্যে ‘সরকারের এজেন্ট ঢুকে পড়েছে’ মন্তব্য করে এ বিষয়ে নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
রোববার রাজধানীর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে দলীয় এক আলোচনা সভায় বক্তব্যে একথা বলেন তিনি।
মির্জা ফখরুল বলেন, “আমাদের মধ্যে এই অবৈধ সরকারের বিভিন্ন এজেন্ট ঢুকে পড়েছে। তারা ঢুকে বিভিন্নভাবে আমাদের মধ্যে বিভেদ-পার্থক্য সৃষ্টি করতে চায়, বিভিন্ন রকম কথা বলে আমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে চায়।
“আমি বলতে চাই, কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। আমরা সবাই ঠিক আছি। শুধু তৃণমূল না, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি যারা বিশ্বাস করে সকল দেশপ্রেমিক এক আছে। আমাদের দরকার শুধু শক্তি সঞ্চয় করে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় আমাদের আঘাত করতে হবে। সেই আঘাতের জন্য আমরা প্রস্তুত হচ্ছি।”
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এই সভায় বুদ্ধিজীবীদের প্রতি পূর্বসূরিদের মতো ‘জেগে ওঠার’ আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।
তিনি বলেন, “আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের। আমি আজকে বাংলাদেশের প্রতিটি বুদ্ধিজীবীর কাছে আহ্বান জানাতে চাই, উঠে দাঁড়ান, আপনাদের পূর্বসূরিদের মতো জেগে উঠুন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, বাংলাদেশের মুক্তিকে রক্ষা করবার জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসুন।
“আমরা অবশ্যই সফল হব।”
সংসদ ভেঙে দিয়ে ‘নিরপেক্ষ’ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে পুনরায় নির্বাচন দিতে ক্ষমতাসীনদের প্রতি আহ্বান জানান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সরকারপ্রধানের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমরা খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই, সময় নেই। অবিলম্বে এই পার্লামেন্ট বাতিল করুন, এই পার্লামেন্ট বাতিল করে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সেই কেয়ারটেকার সরকার যেটা আগে ছিল, সেই কেয়ারটেকার সরকার গঠন করে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে অবিলম্বে নির্বাচন দিন।
“অথবা জনগণের যে ভাষা আছে সেটাকে শিখে নিয়ে জনগণের আন্দোলনকে আপনাকে ফেইস করতে হবে। তখন আর আপনি কোনো সময় পাবেন না।”
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি বক্তব্যে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “আজকে আমরা বেদনার সাথে বলতে চাই, যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা আজকে বাংলাদেশে সম্পূর্ণভাবে ভুলুণ্ঠিত। মূল চেতনা ছিল গণতন্ত্র। আমরা জানি- সকলে ভুক্তভোগী। আজকে গণতন্ত্র আওয়ামী লীগের বাক্সে বন্দি। এই আওয়ামী লীগ এই প্রথমবারই গণতন্ত্রকে হত্যা করেনি, বন্ধ করেনি, এই আওয়ামী লীগ ’৭৫ সালে একদলীয় শাসন ঘোষণা করে সকল দল নিষিদ্ধ করে, চারটি পত্রিকা ছাড়া সকল পত্রিকা বন্ধ করে এদেশে গণতন্ত্র হত্যা করেছিল।
“একাত্তর সালে সেই বুদ্ধিজীবীরা প্রাণ দিয়ে আমাদের দেশকে মুক্ত করেছিলেন আজকে যে বাংলাদেশ এই বাংলাদেশ দেখার জন্য না, মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছিলেন এই বাংলাদেশ দেখার জন্য নয়। আজকে মানুষের অধিকার নাই, ভোট দেয়ার অধিকার নাই, জনগণ অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন নয়। দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা। দেশে আইন নেই, আইনের শাসন নেই, বিচার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে দলীয়করণের কারণে। রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে সরকার ধ্বংস করে দিয়েছে।”
আইনি প্রক্রিয়ায় নয়, সরকার হটানোর মাধ্যমেই খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন বলে মনে করেন খন্দকার মোশাররফ।
সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “নেতা-কর্মীরা এখানে বলেছেন, কর্মসূচি দেন। আমরা কৌশলে অগ্রসর হচ্ছি। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সাথে আমাদের আলোচনা হচ্ছে। আমরা শুধু আপনাদের বলতে চাই, কঠোর আন্দোলন ছাড়া, এই সরকারের পতন ছাড়া দেশনেত্রীর মুক্ত হবে না, গণতন্ত্র মুক্ত হবে। ইনশাল্লাহ, বিএনপির নেতৃত্বে সেই আন্দোলন বাংলাদেশে হবে।”
‘মোশতাক শেখ মুজিবেরই ঘনিষ্ঠজন’
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “কাল উনি বলেছেন যে, খোন্দকার মোশতাক আহমেদ জিয়াউর রহমান সাহেবকে চিফ অব আর্মি স্টাফ নিয়োগ করে তিনি সুবিধা করে দিয়েছেন। খুব খারাপ, খারাপ কথা বলেছেন সেটা আামি উচ্চারণ করতে চাই না।
“আপনি (শেখ হাসিনা) কোথায় ছিলেন তখন? আপনি কি দেখেছেন যে, সেই সময়ে কী অবস্থা ছিল, আপনি কি জানেন যে, সেই সময়ে মানুষ কী অবস্থার মধ্যে গিয়ে পড়েছিল? আপনাদের দলেরই নেতা প্রয়াত শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন খোন্দকার মোশতাক- তিনিই সেদিন ষড়যন্ত্র করে, আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ষড়যন্ত্র করে সেদিন শেখ মুজিবকে সরিয়ে তিনিই সরকার দাবি করেছিলেন, তিনিই সরকার গঠন করেছিলেন।
“আমরা সেই কথা ভুলে যাইনি। আপনারা বিভিন্ন আইন করে, মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে নির্যাতন-নিপীড়ন করে আমাদের মুখকে বন্ধ করতে দিতে চান। এই মুখ তো বন্ধ হবার নয়। সত্য কথা সব সময় উচ্চারিত হবে এবং সত্যের জয় হবে।”
খালেদা জিয়ার জামিন না হওয়ার পেছনে আদালতে শুনানির আগে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ভূমিকার রেখেছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপি মহাসচিব।
তিনি বলেন, “তার আগে সরকারের প্রধান পরিষ্কার করে মেডিকেল বোর্ডকে বলে দিলেন- তিনি তো রাজার হালে আছেন, কী অসুবিধাটা? দ্যাট ইজ এনাফ। এটা একটা মেসেজ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সেই মেসেজ পৌঁছে গেল সবখানে যে, উনি ভালোই আছেন- অসুবিধা নেই।
“ডাক্তার সাহেবদের ওপর প্রেসার ক্রিয়েট করা হল যে, তোমরা যে লিখেছ- এই শব্দগুলো বদলাও। তার আগে ডাক্তার সাহেবরা পরিষ্কার করে বলেছিলেন, সি ইজ ইন অ্যা ক্রিপল স্টেইজ। অর্থাৎ পঙ্গুত্বের অবস্থায় তিনি (খালেদা জিয়া) আছেন। সব কিছুকে উপেক্ষা করে বলে দেয়া হল- জামিন দেওয়া যাবে না।”
একই ধরনের মামলায় ‘আরও অনেক মানুষ, রাজনীতিবিদ, বর্তমান সরকারের সাবেক মন্ত্রীদের’ জামিন দেয়ার নজিরও তুলে ধরেন ফখরুল।
“তাহলে কেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জামিন দেওয়া যাবে না। কারণ ব্যাপারটা রাজনৈতিক, কারণ বিচার বিভাগ স্বাধীন নয়। সেজন্যই এই অবস্থা,” বলেন তিনি।
ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের সমালোচনা
ভারতের পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাসের মাধ্যমে সাতচল্লিশে দেশভাগের যে বিষয়গুলো ছিল, সেগুলোকে আবার সামনে নিয়ে আসা হয়েছে বলে মনে করছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এই আইনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “বলা হচ্ছে, অমুসলিমরা যেতে পারবে, আর মুসলিমদেরকে কোনো নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। বিভাজন দেখেন-বৈষম্য দেখেন। আপনি ভিসা নিয়ে যাবেন ভারতে, ভিসা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে একদিন দেরি হলে আপনাকে দিতে হবে একুশ হাজার টাকা ফাইন। আর আমাদের দাদা নিতাই দাদা বা গয়েশ্বর দাদা-উনারা যদি যান একদিন দেরি করেন তাহলে একশ টাকা। সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপার, যেটা আমরা চিন্তাও করতে পারি না যে, ভারতের মতো দেশে এই ধরনের রাজনীতি শুরু হবে এবং সাম্প্রদায়িক আইন তৈরি হবে।”
এদিক থেকে বাংলাদেশকে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পিঠস্থান’ অভিধা দিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “সবচেয়ে সুন্দর দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ, যেটা আমরা বার বার বলি। আর তারা (ভারতের মন্ত্রী) পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলছেন যে, বাংলাদেশে মাইনোরিটিদের নির্যাতন করা হয়, তার জন্য নাকি এই আইন তৈরি করেছেন।
“এই কথা বললে বলা হবে যে, আমরা ভারতবিরোধী। না, কখনও না। আমরা ভারতবিরোধী নই।”
ভারতের বিরোধিতা নয়, ‘দেশের স্বার্থে’ তাকে এই কথা বলতে হচ্ছে মন্তব্য করে ফখরুল বলেন, “আমার যে সরকার যারা দায়িত্বে আছে, তারা যদি কোনো কিছু না দেখে, কোনো কিছু না বলে। তাহলে কি বলাটাও আমার অপরাধ?”
মির্জা ফখরুলের সভাপতিত্বে ও সহ-প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলিমের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, সেলিমা রহমান, কেন্দ্রীয় নেতা আবদুস সালাম, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, শিরিন সুলতানা, আবদুস সালাম আজাদ, শহীদুল ইসলাম বাবুল।
এছাড়া সহযোগী ও অঙ্গ সগঠনের মধ্যে যুব দলের সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, মুক্তিযোদ্ধা দলের সাদেক আহমেদ খান, উলামা দলের শাহ মো. নেছারুল হক, মৎস্যজীবী দলের রফিকুল ইসলাম মাহতাব, মহিলা দলের সুলতানা আহমেদ, তাঁতী দলের আবুল কালাম আজাদও বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে বিএনপির ফজলুল হক মিলন, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, বিলকিস ইসলাম, রফিক শিকদার, দেবাশীষ মধু, হেলেন জেরিন খান, নজরুল ইসলাম তালুকদার, আব্দুর রহিম, রফিক হাওলাদারসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।