জেলা পরিষদের দুর্নীতি নিয়ে আবারো উষ্মা প্রকাশ করেছে হাইকোর্ট। আদালত বলেছে, ঘুষ খেলেন, দুর্নীতি করলেন, কিন্তু এই অবৈধ কর্মকাণ্ডের চূড়ান্ত পরিণতি কি? একজন মানুষ সর্বোচ্চ ৮০/৯০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। এরপর চূড়ান্ত পরিণতি মৃত্যু। ঘুষ খেয়ে ও দুর্নীতি করে সৃষ্টিকর্তার কাছে কি জবাব দেবেন।
সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের দুর্নীতি নিয়ে করা মামলার শুনানিতে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ রবিবার দুর্নীতিবাজদের উদ্দেশ্যে এই মন্তব্য করেন।
বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নজরুল ইসলাম বলেন, জেলা পরিষদের কিভাবে দুর্নীতি হচ্ছে তা দেখে অবাক হচ্ছি। ১০ বছর ধরে খেয়াঘাটের ইজারার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়নি। এই যে অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হয়নি তখন এই পরিষদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কি করেছেন? দায়িত্ববোধ না থাকলে দেশের উন্নয়ন হবে কিভাবে? দেশ ও জাতির প্রতি আমাদের সকলের দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসা থাকা উচিত।
তিনি বলেন, দুর্নীতি নানা খবর দেখে আমি মাঝে মাঝে হতভম্ব হয়ে যাই। যেখানে দুর্নীতি হয় সেখানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দুর্নীতি বন্ধে কি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন? দুর্নীতি বন্ধে সরকার ও আদালতকে জানাতে হবে। আরো অবাক হই যে বড়দের আঙ্গুলি হেলান ছাড়া পিয়ন চাপরাশিদের দুর্নীতি করা সম্ভব কিনা।
গত ১০ বছরে সাতক্ষীরা জেলার ছয়টি খেয়াঘাট ইজারার প্রায় ১৪ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের প্রধান সহকারী খলিলুর রহমান ও নিন্মমান সহকারী এসএম নাজমুল হোসেনসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। গত ২৭ জানুয়ারি দুদকের খুলনা কার্যালয়ে দায়েরকৃত এই মামলায় আশাশুনি উপজেলার সিউল ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা শাকিলসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আরো ১০ জনকে আসামি করা হয়। এই মামলায় জেলা পরিষদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আসামি না করে অধস্তন দুজন কর্মচারীকে আসামি করায় তলব করা হয় মামলার বাদিকে। একইসঙ্গে জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ তিনজনকে ডাকা হয়। আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক হাইকোর্টে হাজির হন মামলার বাদি দুদকের খুলনা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. নাজমুল হাসান ও জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান হাবিব। ঐ দিন হাইকোর্ট বলেছিলো, দুদকের কর্মকাণ্ডে প্রতীয়মান হচ্ছে যে উনাদের ইচ্ছে হলো কাউকে আসামি করল, ইচ্ছে হলো কাউকে আসামি করল না। কমিশনের এই পিক এন্ড চুজ নীতি (ইচ্ছা নীতি) আমরা অ্যালাউ (গ্রাহ্য) করব না।
শুনানিতে দুদক কৌসুলি খুরশীদ আলম খান বলেন, অনুসন্ধান কর্মকর্তার প্রতিবেদন অনুমোদনের পর এজাহার দাখিল করা হয়েছে। এখানে আসামি করার ক্ষেত্রে কোনো পিক এন্ড চুজ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। আদালত বলেন, গত ১০ বছরে এই জেলা পরিষদে কোনো অডিট হয়েছে? দুদক কৌসুলি বলেন, নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে একবার অডিট হয়েছে। আদালত বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে ইজারার টাকা যে আদায় হয়নি সেজন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কি ঘুমিয়ে ছিলো। যাদেরকে আসামি করা হয়েছে এরা নিন্মমান সহকারী। এদের দায় কি? দুদক কৌসুলি বলেন, এই সময়ের মধ্যে ১৩ জন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। নিন্মমান ক্লার্ক হলেও বড় অফিসারদেরকে এরা ভাঙ্গিয়ে খায়। এরপরই তিনি এজাহার থেকে আসামিদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ আদালতকে পড়ে শোনান।
তিনি বলেন, আমাদের তদন্ত কর্মকর্তার কোনো ভুল হলে তাকে আদালত জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। এমনকি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিতে পারবেন। এ পর্যায়ে দুদক কৌসুলিকে হাইকোর্ট বলে, আপনি কোনো যুক্তিতেই বোঝাতে পারবেন না যে ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সম্মতি ছাড়া এ ধরনের দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। এ ধরনের মামলা আমরা সরাসরি বাতিল করে দেব। এখানে যদি কোনো অনিয়ম পাই তাহলে মামলার বাদিকেও আসামি করার নির্দেশ দেওয়া হবে। দুদক কৌসুলি বলেন, ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সম্মতি ছাড়া এ ধরনের দুর্নীতি সম্ভব নয় আদালতের এই মনোভাব সঠিক। আমরা তদন্ত করছি। তদন্ত শেষেই প্রকৃত দোষীরা বেরিয়ে আসবে। এখানে কাউকে পিক এন্ড চুজ করা হয়নি।
আসামি পক্ষের আইনজীবী মো. ওজি উল্লাহ বলেন, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাইতেই এই মামলা করা হয়েছে। ব্যক্তি বিশেষের দুর্নীতি অধস্তনদের উপর চাপিয়ে কারো অব্যাহতি পাওয়ার সুযোগ নাই।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান হাবিব বলেন, গত ২৭ জানুয়ারি এখানে যোগ দিয়েছি। জেলা পরিষদের অনেক অনিয়ম আছে। ইতিমধ্যে কিছু টাকা আদায় করা সম্ভব হয়েছে। এ পর্যায়ে আদালত বলেন, বাকি টাকা উদ্ধারেও পদক্ষেপ নিন। যারা জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় আনুন। দেশ ও জাতির জন্য কাজ করুন। আদালত বলেন, যত বড় ক্ষমতাধরই হোক না কেন কোনো অনিয়ম থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শুনানি শেষে হাইকোর্ট হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়ে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের অনিয়মের নথি আদালতে দাখিল করতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। এ সময় তার পক্ষে আইনজীবী মাইনুল হাসান ও রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক শুনানি করেন।