দুর্নীতি: দুই ডিআইজির কাহিনী

Untitled-39-5d446651e7818

দু’জন ডিআইজির একজন ডিআইজি মিজানুর রহমান এবং অন্যজন ডিআইজি (প্রিজন) পার্থ গোপাল বণিক-তাদের দুর্নীতির ঘটনা সমাজের সর্বত্র বেশ আলোচিত হয়েছে। সংবাদমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এ দু’জন ডিআইজির নানা চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির খবর একের পর এক ‘অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মতো’ জনগণের সামনে হাজির করেছে। ফলে জনপরিসরে বিদ্যমান আগ্রহ, উত্তেজনা ও আলোচনা অধিকতর তথ্যসমৃদ্ধ হয়েছে, যা দুর্নীতির এ ঘটনাকে আরও চাঞ্চল্যকর করে তুলেছে। খানিকটা বিরতি দিয়ে এ রকম কিছু চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির খবর জনগণের সামনে আসে, যা আমাদের মৌসুমি উত্তেজনায় ভাষায়। তখন আমরা নিজেদের দুর্নীতিকে সাময়িক সামাল দিয়ে রাখি; কারণ ‘বাজার খারাপ’। আর যারা ছোটখাটো দুর্নীতিতে লিপ্ত, তারা খানিকটা আত্মতৃপ্তিতে ভোগী এই ভেবে যে, ‘রাঘববোয়ালরা ধরা পড়লেও চুনোপুঁটিরা জালের বাইরে’ থাকে। ফলে জনপরিসরে আমরা দুর্নীতিবিরোধী বাকোয়াজ অব্যাহত রাখি; কিন্তু ‘নিজের চরকায় কখনও তেল’ দিই না। তাই সমাজে দুর্নীতির মাত্রা নিঃসন্দেহে ক্রমবর্ধমান। কিন্তু দু’জন ডিআইজির দুর্নীতির ঘটনা সমাজে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে; কারণ এ দুর্নীতির মাত্রা এবং পরিধি সমাজের মানুষের কল্পনার মাত্রাকে বেশ খানিকটা অতিক্রম করার পাশাপাশি এর সঙ্গে যুক্ত আছে ক্ষমতা, সুশাসন ও আইনের শাসনের প্রশ্ন।

এখানে মনে রাখা জরুরি, নীতির চল ও চলন যেখানে ক্রমনিমজ্জমান, সেখানে দুর্নীতি ক্রমবর্ধমান হবে, এটাই স্বাভাবিক। সত্যিকার অর্থে দুর্নীতি সর্বত্র বিরাজমান। দুর্নীতি সব দেশেই বিদ্যমান। কোথাও কম, কোথাও বেশি। কোথাও কোথাও দুর্নীতি মানুষের ব্যক্তিজীবন থেকে পেশাগত জীবন এবং রাজনৈতিক জীবন থেকে সমাজ জীবনের নানা পর্যায়ে মানুষ নানা ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত এবং সংযুক্ত। জীবনের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত এ রকম মানুষের সংখ্যা আজকের দিনে সমাজে বিরল। তাই দুর্নীতি একটি সহনীয় মাত্রায় সমাজে সর্বত্র বিদ্যমান এবং মানুষ সেটাকে মেনে নিয়ে নিত্যদিনের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। দুর্নীতি কেবল আর্থিক কিংবা পেশাগত হয় না, দুর্নীতি নানা ফরম্যাটে হতে পারে; মিথ্যা বলা থেকে শুরু করে স্বীয় দায়িত্বে অবহেলাও এক ধরনের দুর্নীতি। কথা দিয়ে কথা না রাখা যেমন দুর্নীতি, তেমনি কথা দেওয়ার কথা থাকলেও কথা না দেওয়াটাও দুর্নীতি। সব ধরনের অসততা, মিথ্যাচার, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, অপেশাদারিত্ব এবং নীতিবিমুখ কর্মকাণ্ডও দুর্নীতি। কিন্তু এ রকম অনেক দুর্নীতি একটা দীর্ঘ অনুশীলনের ভেতর দিয়ে আমরা সমাজে খানিকটা জায়েজ করে নিয়েছি। ফলে দুর্নীতি বলতে আমরা প্রধানত খাদ্যে ভেজাল, আর্থিক কেলেঙ্কারি, ঘুষ লেনদেন, বিভিন্ন প্রকল্পে প্রক্রিয়ার অনিয়ম, টেন্ডার অনিয়ম এবং ক্ষমতার অপ-অবৈধ ব্যবহারকে বুঝে থাকি। ভারতীয় উপমহাদেশে দুর্নীতি প্রধানত একটি আর্থিক বিষয় হিসেবে উপস্থাপিত হয় এবং জনপরিসরে সেভাবেই গৃহীত হয়। তথাপি যখন ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা আর্থিক দুর্নীতি করেন এবং সেটা সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক ভাবনা-চিন্তার বাইরে কোনো ‘অভাবনীয় বিষয়’ হিসেবে হাজির হয়, তখনই সেটা চাঞ্চল্যকর বিষয় হিসেবে জনপরিসরে উপস্থাপিত হয়। অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই মিডিয়া সেসব দুর্নীতির ঘটনা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ ও প্রচার করে এ দর্শন থেকে যে, এ ধরনের দুর্নীতিও সমাজে হয়, সেটা মানুষকে জানানো ও এ ধরনের দুর্নীতির দৃষ্টান্তমূলক এবং দ্রুত বিচার একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার যে জনআকাঙ্ক্ষা তার জন্য বিশেষভাবে জরুরি। সম্প্রতি দু’জন ডিআইজির ভয়াবহ দুর্নীতির খবর একদিকে যেমন আমাদের এসব বিচার-বিবেচনাবোধের পুনর্জন্মের একটা সুযোগ করে দিয়েছে, অন্যদিকে ক্ষমতার অপব্যবহারও কীভাবে দুর্নীতিকে একটা উচ্চমাত্রায় নিয়ে যেতে পারে, তার পুনর্বিবেচনার মওকা দিয়েছে। তাই দু’জন ডিআইজির এসব দুর্নীতির ঘটনা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ-ভাবনার দর্শনকে যথাযথ উপলব্ধির জন্য জরুরি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ দু’জন ডিআইজির ঘটনা সমাজকে কী বার্তা দেয় ?

দুই ডিআইজির কাহিনী

(ড. রাহমান নাসির উদ্দিন, নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় )

ডিআইজি (প্রিজন) পার্থ গোপাল বণিকের ঘটনাটি এ দেশের পুলিশ প্রশাসনের, বিশেষ করে কারা প্রশাসনের অভ্যন্তরের ভয়াবহ দুর্নীতির একটা চিত্রকে উন্মোচিত করেছে। কেননা পার্থ বণিকের দুর্নীতির ঘটনার শুরু ২০১৮ সালের অক্টোবরে। তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস যখন কিশোরগঞ্জের ভৈরবের ট্রেনে ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, দুই কোটি ৫০ লাখ টাকার এফডিআর, এক কোটি ৩০ লাখ টাকার চেক, ফেনসিডিলসহ গ্রেফতার হন, তখন সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েছিল এটা ভেবে যে, একজন জেলার এত টাকা কীভাবে অর্জন করেন! তখন তিনি গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার সহায়ক শক্তি হিসেবে চট্টগ্রামের ডিআইজি (প্রিজন) পার্থ গোপাল বণিকের নাম বলেন। এরই সূত্র ধরে পার্থ গোপালকে দুদকের অনুসন্ধানী টিম জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং পার্থ গোপালের তথ্যের ভিত্তিতে দুদক সম্প্রতি ৮০ লাখ টাকা তার বাসা থেকে উদ্ধার করে। পার্থ গোপাল অস্বীকার করলেও তার গাড়ি ও বাড়ি সবই অবৈধ সম্পদ বলে দুদক কর্মকর্তারা মনে করেন। এটা সহজেই অনুমেয় যে, সোহেল রানা এবং পার্থ গোপালের এ বিপুল পরিমাণ অর্থ কোনো বৈধ উপায়ে আসেনি। কেননা একজন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর পক্ষে কেবল বেতন-ভাতা থেকে সারাজীবন চাকরি করেও উপার্জন করা সম্ভব নয়। এ সম্পদ পৈতৃক সূত্রে বা বৈবাহিক সূত্র থেকে পেয়েছেন, যা পার্থ গোপাল দাবি করছেন না। এটা তদন্তাধীন বিষয়। কিন্তু আইন-আদালতের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই সাধারণ মানুষের জেনারেল পারসেপশন হচ্ছে, এ টাকা এবং সম্পদ অবৈধ। তখনই প্রশ্ন আসে, এত টাকা এবং সম্পদের বিনিময়ে কী পরিমাণ অন্যায়, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আইনের অপশাসন হয়েছে, তা ভাবতেই অবাক লাগে। কেননা এত টাকা কেউ এমনি এমনি দেয়নি। ডিআইজি মিজানুর রহমানের  ঘটনা তো আরও ভয়াবহ। ইতিমধ্যে  দু’জনকেই বরখাস্ত করা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারসাপেক্ষে হয়তো গৃহীত হবে চূড়ান্ত ব্যবস্থা।

ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের পাশাপাশি নানা অভিযোগ রয়েছে। নিজের পদ-পদবি ব্যবহার করে প্রথমে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে এবং পরে ডিআইজি হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানা দুর্নীতি করা, বদলি বা চাকরিচ্যুতির ভয় দেখিয়ে নিজের সহকর্মীদের নানা অবৈধ কাজে বাধ্য করা, টি২০ ক্রিকেট বিশ্বকাপে ডিউটির কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নামে নিয়মিতভাবে মোটা অঙ্কের ঘুষ নেওয়া এবং এক নারীকে তুলে নিয়ে (২০১৭ সালের জুলাই মাসে) বিয়ে করাসহ নানা ধরনের নারী কেলেঙ্কারিসহ বহু অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। সর্বশেষ দুদকের তদন্ত পরিচালক এনামুল বসরকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না করার জন্য ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে চারদিকে হৈচৈ ফেলে দেন। এভাবেই অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে ডিআইজি মিজান নানা দুর্নীতির অভিযোগ সত্ত্বেও বহাল তবিয়তে কয়েকদিন আগেও সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে বেড়িয়েছেন; কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। দুদকের পরিচালক বসরও নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। এরপর আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার হাত ধরে হয়তো কারও কারও শাস্তি হবে কিংবা কেউ কেউ মুক্তি পাবে। অবশ্য এটি এখানে আলোচনার বিষয় নয়। এ নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা হতে পারে নানাভাবেই।

কিন্তু কথা হচ্ছে, দুর্নীতির এসব ঘটনা সমাজে ভিন্ন এক ধরনের বার্তা দেয়। কেননা এসব ঘটনা কেবল কোনো ব্যক্তিবিশেষের সাধারণ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নয়। ডিআইজি (প্রিজন) পার্থ গোপাল বণিক, চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস, ডিআইজি মিজানুর রহমান এবং দুদকের তদন্ত পরিচালক এনামুল বসরের এসব দুর্নীতির ঘটনা সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে এ কারণে ভিন্ন বার্তা দেয়। কারণ ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, পদ-পদবি এবং এখতিয়ার বিবেচনায় এরা সাধারণ মানুষ নন। ফলে এদের দুর্নীতি কেবল ‘ছেঁচড়া’ দুর্নীতি নয়, এর মধ্যে সম্পৃক্ত এবং সংযুক্ত আছে ক্ষমতা ও ক্ষমতা ব্যবহারের পরিসর ও পরিধি, সরকারি আমলাতন্ত্র ও তার জনসেবার প্রশ্ন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর ভূমিকা ও প্রজাতন্ত্রের সেবা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান ও জনগণের আস্থার প্রশ্ন, আইনের শাসনের প্রশ্ন, বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি সুশাসনের প্রশ্ন। তাই এসব ঘটনাকে আর দশটা সাধারণ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে না দেখে সমাজের অভ্যন্তর এবং আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোর একটি গভীর সংকট হিসেবে দেখতে হবে। দুর্নীতির মাত্রা ও পরিধি বিবেচনায় এসব ঘটনা সমাজের একটি নিকৃষ্ট এবং জঘন্য চেহারা আমাদের সামনে হাজির করে, যেটা সত্যিকার বাংলাদেশের আসল চেহারা নয়। যেখানে শ্রমিক (পোশাক শ্রমিক থেকে অন্য কারখানার শ্রমিক), মজুর (দিনমজুর থেকে প্রবাসী শ্রমিক) এবং চাষি (এ দেশের খাদ্য উৎপাদনের মূল কারিগর) অমানবিক পরিশ্রম করে এ দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার পাশাপাশি অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচককে ঊর্ধ্বমুখী করার যুদ্ধে নিত্য নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিচ্ছেন, সেখানে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে সমাজের সর্বস্ব লুট করেছে একশ্রেণির অসাধু ও দুর্নীতিবাজ। তাই এ ধরনের দুর্নীতির ঘটনা সমাজকে একটা বড় ধরনের ধাক্কা দেয়। আমরা আশা করি, এ ধাক্কা কেবল দু’জন ডিআইজিকেই দেবে না, সমাজের সর্বত্র যেন এ ধাক্কা লাগে, যাতে করে আমরা নিজেদের যে যার জায়গা থেকে দুর্নীতিমুক্ত করে একটি সুন্দর বাংলাদেশ নির্মাণে অবদান রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখব। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সামনে আমরা যেন দুর্নীতিবাজ নই, দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে উদাহরণযোগ্য হয়ে উঠতে পারি- এ কামনা নিরন্তর।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন,

নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ।

Pin It