দেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ২ লাখ ৩১ হাজার !

image-119999-1578253139

বহু বিতর্কের পর এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ঘোষিত মুজিববর্ষের শুরুতেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এই তালিকা প্রকাশ করবে। এজন্য চলছে নানা প্রস্তুতি। তবে গেল ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখে প্রকাশিত ভুলে ভরা রাজাকারের তালিকা স্থগিত করে তা আবার ২৬ মার্চ প্রকাশের কথা বলা হলেও তা নিয়ে কোনো প্রস্তুতি নেই মন্ত্রণালয়ের। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানিয়েছিলেন, জেলাওয়ারি তালিকা সংগ্রহ করে রাজাকারের তালিকা করা হবে। তবে জেলাগুলোতে নতুন করে মন্ত্রণালয়ের কোনো বার্তা যায়নি বলে জানা গেছে। আর রাজাকারের তালিকা প্রকাশের দিনই মন্ত্রী ঘোষণা দেন যে আসছে স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ করা হবে।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী ২৬ মার্চ কমবেশি ২ লাখ ৩১ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা প্রকাশ করা হবে। ভারতীয় তালিকা, লাল মুক্তিবার্তা, সরকারি গেজেট ও সনদধারী, সেনা-নৌ, বিমান বাহিনী ও পুলিশের গেজেট, মুজিবনগর গেজেট এবং বীরাঙ্গনা গেজেটে যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত আছে, তাদের নাম গেজেট আকারে একত্রিতভাবে প্রকাশ করা হবে। এর বাইরে সবুজ মুক্তিবার্তা বা শুধু গেজেটে নাম আছে কিন্তু সনদ নেই—তাদের মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বাইরে রাখা হচ্ছে। প্রসংগত, স্বাধীনতার পর একাধিক সরকার একাধিকবার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়ন করলেও তা নিয়ে বিতর্কের অবসান হয়নি। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে তালিকাও বদল হয়েছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা অমুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন, আবার অনেক অমুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছেন মুক্তিযোদ্ধা। একেক সময়ে তৈরি করা হয়েছে একেক রকমের মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা। এ নিয়ে ৩১ হাজার মামলাও হয়েছে।

জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে ১৯৭২ সালে ঘোষিত দ্য বাংলাদেশ (ফ্রিডম ফাইটারস) ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অর্ডার অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা না মানা, একেক সময়ে একেক ধরনের সংজ্ঞা প্রবর্তন, সর্বোপরি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোনো আইন প্রবর্তন না করায় বস্তুত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নতুন বিতর্কের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ খান বীরবিক্রম বলেন, ‘কারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত হবেন, সেটি ১৯৭২ সালের অর্ডারে স্পষ্ট রয়েছে। এটি নিয়ে বারবার বিতর্ক করে মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করা হচ্ছে।’ তার মতে, মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা নতুন করে নির্ধারণের কিছু নেই। এটি নির্ধারিত আছে। ১৯৭২ সালের অর্ডারের যে ব্যাখ্যা তিনি দিচ্ছেন তাতে তিনি বলছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি, যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত যে কোনো সংগঠিত দলের (ফোর্স) সদস্য হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত কোনো সংগঠিত দলের সদস্য না হন এবং হয়েও যদি সক্রিয় ভূমিকা না রাখেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পড়বেন না।’

উল্লেখ্য, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা সম্পর্কে ১৯৭২ সালের অর্ডারে ইংরেজি ভাষায় যা বলা হয়েছে, সেটি এখনো বহাল। তা হলো, ‘ফ্রিডম ফাইটারস (এফএফ) মিনস অ্যানি পারসন হু হ্যাড সারভড অ্যাজ মেম্বার অব অ্যানি ফোর্স এনগেজড ইন দ্য ওয়্যার অব লিবারেশন।’

এদিকে বর্তমানে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে, যেটি অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন পায়নি এখনো। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের একটি উপকমিটি এ সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। এর আগে ২০০৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীর অবসরের বয়স বাড়ানোর পর ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্কালীন সচিব মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান একটি পরিপত্র জারি করেন। এতে কারা মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারী হবেন, তার সংজ্ঞা বা চারটি শর্ত দেওয়া হয়। এসব শর্ত হচ্ছে :যারা চাকরিতে প্রবেশের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন অথবা যাদের নাম লাল মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাদের নাম গেজেটে প্রকাশ হয়েছিল কিংবা যাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সই করা সনদ রয়েছে—এই চারটির যে কোনো একটি শর্তে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগ পান মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীরা। যদিও এখন আবার বলা হচ্ছে, চাকরিতে প্রবেশের সময় মুক্তিযোদ্ধার কোটা সুবিধা না নিলে পরে আর কেউ মুক্তিযোদ্ধার সুবিধা পাবেন না।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৯৭২ সাল থেকে অদ্যাবধি মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও সংখ্যা নির্ধারণে ভিন্নতা রয়েছে। কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণেই ’৭২-এর নির্দেশ পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়নি। আর এটি না করায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক।

মুক্তিযুদ্ধের পর সেক্টর কমান্ডার ও সাবসেক্টর কমান্ডারদের প্রকাশনা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭ হাজার। অর্থাত্, মোট ১ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ জন। আবার সেক্টর থেকে পাওয়া (মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর বিলুপ্তির পর এসব দলিল ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণ ও রেকর্ড সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইবিআরসিতে স্থানান্তর করা হয়) দলিলে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭০ হাজার ৮৯৬ জন। এতে বাকি ৬০ হাজার ৯০৪ জনের খোঁজ পাওয়া যায়নি।

অপরদিকে ১৯৯৮ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্কালীন ডিজি মমিনউল্লাহ পাটোয়ারীর নেতৃত্বে জেলা ও উপজেলা কমান্ডারদের নেতৃত্বে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির মাধ্যমে একটি তালিকা করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে সংরক্ষণ করা হয়। এটিই এখন লাল বই নামে সমধিক পরিচিত। এতে ১ লাখ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে। তবে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্র জানায়, এই তালিকায় ইবিআরসিতে সংরক্ষিত তালিকাভুক্ত (৭০ হাজার ৮৯৬ জন) অনেকের নাম নেই।

এরপর ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। সে সময় আগের নীতি বাদ দিয়ে তত্কালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সুপারিশে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে বাদ রেখে ইউএনও ও ডিসিদের নিয়ে উপজেলা ও জেলা যাচাইবাছাই কমিটি করা হয়। তাদের সুপারিশে ২০০৩ ও ২০০৪ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করে দুটি গেজেট প্রকাশ করা হয়। এর একটি ছিল বিশেষ গেজেট, যেখানে সামরিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৩৯ হাজার এবং অপর গেজেটে ছিল ১ লাখ ৫৯ হাজার। দুটি মিলে তখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজারে। অর্থাত্, জোট সরকারের সময় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ে ৪৪ হাজার।

Pin It