পাবনার পর এবার লালমনিরহাটে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের শিকার ওই স্কুলছাত্রীকে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেন পুলিশের এক এসআই। এ ব্যাপারে ছাত্রীর পরিবার অভিযোগ দিলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। সদর থানার এসআই মাইনুল ইসলামের ‘পরামর্শে’ ধর্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে উল্টো ৫০ হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে বিয়ে দেন মেয়েটির ভ্যানচালক বাবা। ভুক্তভোগী পরিবারটির বাড়ি উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের একটি গ্রামে।
এদিকে, বিয়ে হলেও মেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় কাবিননামা হাতে পায়নি তার পরিবার। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ছেলেপক্ষ বিয়ে অস্বীকার করে মেয়েটিকে ঘরে তুলছে না। তারা উল্টো এলাকাছাড়া করার হুমকি দিচ্ছে মেয়ের পরিবারকে। মেয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পুলিশ অভিযোগটি আমলে নিলে তাদের এমন নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।
এ ব্যাপারে গত রোববার মেয়ের বাবা পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি, জেলা পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দেন। সম্প্রতি পাবনা সদর থানায় ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারীর বিয়ে দেন থানার ওসি। এ ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। গতকাল বুধবার সেই ওসি ওবাইদুল হককে সাসপেন্ড করা হয়েছে। লালমনিরহাটেও একই রকম ঘটনায় ফের পুলিশের সংশ্নিষ্টতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
লালমনিরহাটে মেয়ের বাবার লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, প্রতিবেশী অচিমন বিবির বাড়িতে স্থানীয় কয়েক শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতেন একই ইউনিয়নের উমাপতি হরনারায়ণ গ্রামের আফজাল হোসেনের ছেলে শাহিন আলম। সেখানে সপ্তম শ্রেণির ওই মেয়েটিকেও মাসিক ৪০০ টাকা বেতনে পড়তে দেন তার বাবা। কিছুদিন পড়ার পর শাহিন তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেন। সে রাজি না হলে শিক্ষক তার মোবাইল ফোনে আগে গোপনে তোলা কয়েকটি ছবি দেখিয়ে হুমকি দেন। শিক্ষক তাকে বলেন- যদি তার প্রস্তাবে রাজি না হয়, তবে এসব ছবি খারাপ বানিয়ে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেবেন। এই ভয়
দেখিয়ে প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করেন তিনি। পরে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে বাচ্চা নষ্ট করতে ওষুধ খাওয়ান শাহিন। ওষুধে কাজ না হলে গত ২৫ জুলাই ওই শিক্ষার্থীকে কৌশলে তুলে নিয়ে শহরের মেরী স্টোপ ক্লিনিকে অবৈধ গর্ভপাত ঘটান। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে ইউপি চেয়ারম্যানের পরামর্শে মেয়েটির বাবা গত ১১ আগস্ট সদর থানায় একটি অভিযোগ দেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাতেই এসআই মাইনুল ইসলাম বাড়িতে এসে মেয়েটিকে বলেন- বিয়ে করবা নাকি জরিমানা নিবা। একপর্যায়ে এসআই বলেন, ৫০ হাজার টাকা দিলেই ছেলেপক্ষ বিয়েতে রাজি হবে।
মেয়েটির বাবা জানান, নিরুপায় হয়ে এসআই মাইনুল ইসলামের প্রস্তাবে রাজি হয়ে সুদের ওপর ৫০ হাজার টাকা নিয়ে ছেলেকে যৌতুক দিয়েছেন। ২৩ আগস্ট উপজেলার মহেন্দ্রনগর ইউনিয়নের শহিদুল কাজির কাছে বিয়ের নিবন্ধন হয়। তবে মেয়ের বয়স কম হওয়ায় কাজি কাবিননামা সরবরাহ করেনি। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাত্র শাহিন আলম মেয়েটিকে বাবার বাড়ি রেখে চম্পট দেন। তালাক হয়ে গেছে বলে এলাকায় বলে বেড়াচ্ছেন তিনি।
মেয়ের বাবা আক্ষেপ করে বলেন, থানায় দেওয়া অভিযোগটি যদি মামলা হিসেবে নেওয়া হতো, তাহলে তাদের এমন অবস্থায় পড়তে হতো না।
মেয়ের মা বলেন, ‘বাহে, গরিব বলি হামার কি মান-সম্মান নাই। হামাকগুলাক এলাকাছাড়া করার হুমকি দেয়।’
মেয়েটি জানায়, এসআই মাইনুল ইসলাম তাকে বলেছিলেন- তুমি জরিমানা চাও, নাকি বিয়ে চাও। তখন বলেছিলাম, আমি ওর শাস্তি চাই। কিন্তু এসআই বিয়ের পরামর্শ দিয়েছিলেন বাবাকে।
অভিযুক্ত শাহিন আলম বলেন, এখন তো সবাই জানে। এসআই বলছেন, আমি বিয়ে করছি, ঘটনা এ পর্যন্তই।
পঞ্চগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৬ নম্বর ওয়ার্ড যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক বলেন, এটাকে বিয়ে বলা যায় না। বাল্যবিয়ে হয়েছে। বিয়ের কোনো কাগজ নেই। দায়িত্বহীনতার কাজ হয়েছে।
ইউপি চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন বলেন, মেয়ের বাবাকে থানায় অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। যেহেতু এটা ধর্ষণ ও অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিষয়, তাই এটা আইনগতভাবেই সমাধান হওয়া উচিত।
এসআই মাইনুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে লালমনিরহাট থানার ওসি মাহফুজ আলম বলেন, পুলিশ সুপার বিষয়টি দেখার জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। মেয়ের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ায় তাদের বিয়ে দিয়েছে এলাকাবাসী- এমন কথা জানিয়েছেন এসআই মাইনুল।
জেলা পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক বলেন, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখব। তদন্ত করে দোষী প্রমাণিত হলে এ ঘটনায় জড়িতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।