‘ধর্ষিতা‘ নয়, ধর্ষণের শিকার: সংসদে বিল পাস

image-365297-1605536679

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ‘ধর্ষিতা’ শব্দটি বদলে ‘ধর্ষণের শিকার’ শব্দবন্ধ বসিয়ে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে সংসদে আনা বিল পাস হয়েছে।

মঙ্গলবার মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল-২০০০‘ সংসদে পাসের প্রস্তাব করেন। পরে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।

ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে বিলটি গত ৮ নভেম্বর সংসদে উত্থাপনের পর তা পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল।

সোমবার সেই প্রতিবেদন সংসদে উত্থাপন করেন সংসদীয় স্থায়ী কমিটিটির সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি।

ধর্ষিতা শব্দটি লিঙ্গ বৈষম্যের পরিচায়ক বলে বিভিন্ন সময় মত আসার প্রেক্ষাপটে বিলে ‘ধর্ষণের শিকার’ শব্দবন্ধ দিয়ে ‘ধর্ষিতা’ শব্দটি প্রতিস্থাপনের সুপারিশ করেছিল সংসদীয় কমিটি।

মূল আইনের ৯ (২) ধারাসহ কয়েক জায়গায় ‘ধর্ষিতা’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘ধর্ষণের শিকার’ শব্দটি বসছে।

দেশজুড়ে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলন এবং ধর্ষণকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবির মধ্যে সরকার আইনটি সংশোধনের পদক্ষেপ নেয়। যদিও সামাজিক অবস্থা না বদলালে শাস্তি বাড়িয়েও কোনো লাভ হবে না বলেও মত রয়েছে।

সংসদ অধিবেশন না থাকায় সংশোধিত আইন কার্যকর করতে গত ১৩ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০০০’ জারি করেন।

পরে ৮ নভেম্বর নিয়ম অনুযায়ী অধ্যাদেশটি সংসদে তোলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। একই দিন সেটি বিল আকারে সংসদে তোলা হয়।

২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) উপধারায় বলা ছিল, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।

বিলে মূল আইনের খসড়ায় ৯(১) উপধারায় ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।

আইনের ৯(৪) (ক) উপধারায় ছিল- ‘যদি কোনো ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করিয়া মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।

এই উপধারা সংশোধন করে পাস হওয়া বিলে ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ এর পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলো যোগ করা হয়েছে।

অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ধর্ষণ ছাড়া সাধারণ জখমের ক্ষেত্রে অপরাধ আপসযোগ্য হবে। এছাড়া আগের আইনে ১৯৭৪ সালের শিশু আইনের রেফারেন্স ছিল। এখন সেখানে হবে ‘শিশু আইন- ২০১৩’।

২০০০ সালের আইনের ৩২ ধারায় বলা ছিল, “এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধের শিকার ব্যক্তির সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করিয় মেডিকেল পরীক্ষা সরকারি হাসপাতালে কিংবা সরকার কর্তৃক এতদুদ্দেশ্যে স্বীকৃত কোন বেসরকারি হাসপাতালে সম্পন্ন করা যাইবে।”

বিলে অপরাধের শিকার ব্যক্তির পাশাপাশি ‘অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির’ মেডিকেল পরীক্ষা করার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে।

এছাড়া ৩২ ধারার সঙ্গে ৩২(ক) শিরোনামে নতুন একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছে বিলে।

সেখানে বলা হয়, “এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির ধারা ৩২ এর অধীন মেডিকেল পরীক্ষা ছাড়াও, উক্ত ব্যক্তির সম্মতি থাকুক বা না থাকুক, ২০১৪ সালের ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) আইনের বিধান অনুযায়ী তার ডিএনএ পরীক্ষা করতে হবে।”

বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “সামাজিক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের প্রাগ্রসরমান ধারা আজ বিশ্বব্যাপী নন্দিত ও প্রশংসিত। বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ঊর্ধ্বগামী পরিক্রমণের মধ্যে দেশে নারী ও শিশু ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ সংঘটন, সামাজিক গতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব রাখাসহ সার্বিক সামাজিক উন্নয়নের ধারাকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

“এইরূপ হীন অপরাধ দমনে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণার্থে দণ্ডারোপের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা গ্রহণ-সময় ও পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় অত্যাবশ্যক।“

যে নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, সেজন্য তাকেই আবার দোষারোপ করছে এ সমাজের কেউ কেউ। বুয়েট ক্যাম্পাসের রাস্তার ধারে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নিপীড়নের সেই বাস্তবতা। ছবি: মাহমুদ জামান অভিযে নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, সেজন্য তাকেই আবার দোষারোপ করছে এ সমাজের কেউ কেউ। বুয়েট ক্যাম্পাসের রাস্তার ধারে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নিপীড়নের সেই বাস্তবতা।

বিলটি পাসের প্রক্রিয়া চলার সময় জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাব তুলে খসড়া আইনটির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন।

জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করাকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, “ধর্ষণকারী ও শিকার উভয়ের ডিএনএ টেস্ট যে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তা সরকারি ব্যয়ে করা হবে, না অভিযুক্ত বা অভিযোগকারী কে ব্যয় বহন করবে,তা পরিষ্কার না।“

জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম বলেন, “অত্যন্ত ভালো ও জরুরি আইন, কিন্তু আইনে ব্যত্যয় ঘটেছে। অর্ডিন্যান্স যখন আইন হয়, হুবহু বিলটা হতে হয়।

“কিন্তু কমিটি থেকে ঘুরে এসে কীভাবে সংশোধনী.. সেটা মূল আইনের সংশোধনী। অর্ডিন্যান্স আইনে হলে হুবহু হবে। সংশোধন আনতে হলে পরে আনতে হবে।“

বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, সামাজিক চাপে নারীরা ধর্ষণের বিচার চাইতে অনেক সময়ই সাহসী হন না। যে কারণে মামলা কম। যেগুলো হয় সাজার হারও খুব কম।

“৩ শতাংশ ক্ষেত্রে সাজা হয়। ৯৭ শতাংশে ছাড়া পাচ্ছেন। বর্তমানে যখন পারছি না, সাজা বাড়িয়ে কতটুকু করতে পারব, সে প্রশ্ন করা যায়। মাদকে ২৫ গ্রামের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে কিন্তু তাতে কি মাদক ব্যবহার কমেছে?“

জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, “এই আইন নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার দরকার ছিল। ম্যারিটাল রেপ চলে আসছে। অনেক স্ত্রী বাড়িতে শিকার হয়। সেম সেক্স, পুরুষ শিশুকে ধর্ষণ করলে কী হবে, কোথাও নেই। ক্রস একজামে নারীর চরিত্র নিয়ে দ্বিতীয়বার ধর্ষণ করা হয়। সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই।“

বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, “ইসলামিক ফাউন্ডেশন, আলেমদের মতামত নেওয়া দরকার ছিল। আইন করতে যাচ্ছি। অর্ডিনেন্স জারির পর আজকের পত্রিকায় আছে ধর্ষণ হচ্ছে। মৃত্যুদণ্ড বাড়িয়ে ধর্ষণ প্রতিরোধ হবে না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। ধর্ষণের পথ বন্ধ করতে গেলে ইলিগ্যাল সেক্সুয়াল রিলেশন অপরাধের মধ্যে আনতে হবে।“

Pin It