বাবার সীমিত আয়ের কথা শাহান জানে। তাই সে যখন-তখন এটা-সেটা আবদার করে না। কোন কিছু পাওয়ার জন্য গো ধরে না।
বাবার ইচ্ছে শাহানকে অনেক কিছু কিনে দেয়ার। কিন্তু সামর্থে সব সময় কুলোয় না।
বছরের শেষ বিকেল আজ। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে আরো একটি বছর। বাবা বাইরে বেরুচ্ছেন। ছেলের জন্য নিশ্চয়ই কিছু কিনে আনবেন। শাহানের মা এটা খুব ভালো করেই জানেন।
বেতন পেতে আরও বেশ কয়েকদিন বাকি। তাই হুট করে যেন দামি কিছু কিনে না বসেন সেটি মনে করিয়ে দিলেন শাহানের বাবাকে। তিনি মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মার্কেটগুলোতে অন্য দিনের চেয়ে একটু বেশি ভিড় আজ। সন্ধ্যা থেকে উৎসবে মাতবে ছোট-বড় সবাই। কেউ বাবা-মার সঙ্গে, কেউ বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে। প্রস্তুতি নিতে নানা রকমের আয়োজন করা হয়েছে। বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছে বাসা-বাড়ির ছাদ, ঘরের ড্রয়িং রুম।
সন্ধ্যা হতে বেশি বাকি নেই। মার্কেটের দোকানগুলো ছোট ছোট মরিচবাতি দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। বাচ্চাদের নজর কাড়তে কিছু কিছু দামি খেলনা দোকানের বাইরেও সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
সাদা-কফি রঙের পান্ডা শাহানের ভীষণ পছন্দ। একবার মার্কেটে গিয়ে সে বাবার কাছে ওই পান্ডা কিনে দেয়ার আবদার করেছিল। সেদিনও মাসের শেষ দিন ছিল। বাবার পকেটে তেমন কোনো টাকা ছিল না। তাই, মা শাহানের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে ফুচকা খাওয়ার কথা বলেছিলেন। বাবা-মার দিকে তাকিয়ে শাহান আর কিছু বলেনি। মার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পান্ডা কিনে দিতে না পারায় বাবা পেয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি কষ্ট।
শাহানের আবদার করা সেই পান্ডাটি বাবা আজ কিনে দেবেন বলে ঠিক করেছেন। মার্কেটের সেই দোকানটিতে গেলেন তিনি। সামনে অনেক ভিড়। অনেক রঙের পান্ডা। তাদের মধ্য থেকে সাদা-কফি রঙের পান্ডাটি খুঁজে বের করলেন তিনি।
সেলসম্যানের কাছে দাম শুনে অবাক হলেন। বললেন, কিছুদিন আগেও তো এটার দাম এতো ছিল না। সেলসম্যান তাকে বছরের শেষ দিন ও নববর্ষের কথা মনে করিয়ে দিলেন। বললেন, কিছুক্ষণ পরে এটাই দেখেন কত দাম হয়! অন্য দোকান যাচাই করে দেখতে পারেন। সামান্য কিছু কমানোর কথা বলে পকেট থেকে টাকা বের করে পান্ডাটি হাতে নিলেন শাহানের বাবা।
সন্ধ্যার বাতিগুলো অনেক আগেই জ্বলে উঠেছে। মানুষে গমগম করছে রাস্তা। হেঁটে বাসায় ফিরছেন শাহানের বাবা। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। দ্রুত হাঁটায় তার তেমন শীত লাগছে না। হঠাৎ পকেটে থাকা মোবাইলে একটি জরুরি ফোন এলো। তাই বাসায় না গিয়ে একটি কাজের জন্য তাকে অন্যখানে যেতে হলো। সেখানে কথাবার্তা বলে বাসায় ফিরতে অনেকটা সময় লেগে গেল তার।
ফেরার পথে ফুটপাতের পাশে শীতে কষ্টে থাকা মানুষগুলোকে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। শিশুদের কথা ভেবে তার চোখে পানি এসে গেল। ভাবলেন, আর কিছুক্ষণ পর তিনি ঘরে ঢুকে যাবেন। কম্বল গায়ে শুয়ে পড়বেন। কিন্তু এই মানুষগুলো তো সারারাতই কনকনে শীতের মধ্যে কাটাবেন। ঠিক করলেন বাসায় রাখা অতিরক্তি কম্বলটি ফুটপাতে থাকা কাউকে দিয়ে দেবেন।
রাত ১২টা। শাহান ঘুমোচ্ছে। চারপাশ থেকে আতশবাজি ফোটানোর শব্দ আসছে। বাবা শাহানকে ঘুম থেকে তুলতে গিয়েও তুললেন না। ভাবলেন ছেলেকে একটা সারপ্রাইজ দেবেন। সকালে ঘুম থেকে জেগে পান্ডা দেখে শাহান নিশ্চয়ই অনেক খুশি হবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। শাহানকে আর ঘুম থেকে জাগালেন না। ছেলেকে ঘুমে রেখে বাবা-মা বাসার সামনের ফুটপাতে থাকা দরিদ্র মা ও শিশুকে একটি কম্বল দিয়ে এলেন।
সকালে শাহানের ঘুম ভাঙলো। বিছানায় শুয়ে মাকে ডাকতে লাগলো সে। মা আলো জ্বালিয়ে দিতেই ওয়ারড্রপের ওপরে রাখা সাদা-কফি রঙের পান্ডা দেখে শাহান ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে পান্ডাটি এনে আবার বাবার পাশে শুয়ে পড়লো।
বাবা তখন নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর ঘুম ভাঙতেই দেখেন শাহান পান্ডাটিকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। বাবা শাহানকে জড়িয়ে ধরলেন। নববর্ষের প্রথম সকালে ছেলের খুশি দেখে বাবা-মাও হেসে উঠলেন।