বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘দেশের আইন আদালত এখন ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাপূরণে নগ্নভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এ যাবৎ যত মামলা-মোকদ্দমা করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই মিথ্যা, আজগুবি ও হাস্যকর মামলা শুরু হয় ওয়ান ইলেভেনে অসাংবিধানিক ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকারের সময়ে।
তিনি বলেন, ‘প্রহসনের নির্বাচনে ক্ষমতায় বসেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নিজের নামে থাকা ১৫টি মামলা এক ফরমানেই প্রত্যাহার করিয়ে নেন। অথচ মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় বিচারের নামে অবিচার চলছে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে। আদালতকে ব্যবহার করে দুইটি মিথ্যা মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়ার পর এবার আবারো ‘নাইকো দুর্নীতি’ নামে একটি ভুয়া মামলায় বিচারের নামে অবিচারের মহড়া চলছে। কানাডিয়ান কোম্পানি ‘নাইকো’র সঙ্গে গ্যাস নিয়ে তৎকালীন বিএনপি সরকার যে চুক্তি করেছিল, সেই চুক্তিতে খালেদা জিয়া দুর্নীতি করেছেন এটা প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে সরকার। এ মামলায় খালেদা জিয়াকে ফাঁসানোর জন্য কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে বসানো হয়েছে অস্থায়ী আদালত।’
রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘দেশে লক্ষ লক্ষ মামলা বিচারাধীন থাকলেও শুধুমাত্র খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে সরকারের তড়িঘড়ি প্রমাণ করে তারা আরেকটি ভুয়া অভিযোগে ভুয়া রায় চায়। অথচ নাইকো মামলায় আসলে কোনো দুর্নীতিই হয়নি। ২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এই রায় দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অফ ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউটস (আইসিএসআইডি)’র আওতাধীন প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সালিশি ট্রাইব্যুনাল।’
বৃহস্পতিবার বিকালে বিএনপির নয়া পল্টন কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে রিজভী এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ডা. আব্দুল কুদ্দুস, ওবায়দুল ইসলাম, যুগ্ম-মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন ও প্রকাশনা সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিব প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
রিজভী ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের বিস্তারিত তুলে ধরে বলেন, ‘এই রায়ে বলা হয়েছে কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকোর সঙ্গে গ্যাস নিয়ে তৎকালীন বিএনপি সরকার যে চুক্তি করেছিল তাতে কোন রকমের দুর্নীতি হয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং অন্যদের বিরুদ্ধে এ মামলায় যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার কোন রকমের প্রমাণ বা ভিত্তি নেই। তবে নাইকো মামলার এই রায় যাতে জনগণ জানতে না পারে এ কারণে জনম্যান্ডেটহীন এই সরকার আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘আইসিএসআইডি’র ওপর চাপ সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক সালিশ নিষ্পত্তিকারী ট্রাইব্যুনালের রায়ের তথ্য ইচ্ছে করে গোপন রেখেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। তবে নাইকো নিয়ে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সালিশি ট্রাইব্যুনালের এই রায়ের ডকুমেন্ট এর ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান সম্প্রতি একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তার সম্পাদিত আলোড়ন সৃষ্টিকারী আন্তর্জাতিক নিউজ মিডিয়া ‘নেট্রা নিউজ’ এ। নাইকো’র চুক্তির কথিত দুর্নীতি নিয়ে ‘নেট্রা নিউজে’র হাতে থাকা ৫৭১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং আরো আটজনের বিরুদ্ধে নাইকো মামলায় দুর্নীতি ও ঘুষ আদান-প্রদানের অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন।ট্রাইব্যুনাল থেকে আরো বলা হয়-ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষ থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী পুত্র তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সরকারি প্রভাব খাটানো এবং আর্থিক অনিয়মের যে অভিযোগ করা হয়েছে তারও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’
আইসিএসআইডি এর পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার মামলার প্রকৃত কোনো তথ্য তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং সরকারের কথার সঙ্গে অমিল খুঁজে পাওয়া গেছে। এতে বলা হয়, নাইকোর কাজ পাওয়াটা ছিলো যথাযথ। বৈধভাবেই ছাতক গ্যাসফিল্ডের চুক্তি হয়েছিলো, আর তাতে লাভবান হয়েছিলো বাপেক্স আর পেট্রোবাংলাই। নাইকোর সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশের উৎপাদন নীতিমালার বরখেলাপ হয়েছে এমন কথার যথার্থতা নেই।আইসিএসআইডি’ পরিচালিত ট্রাইব্যুনালে অংশ নেওয়া তিন বিচারক হলেন-ট্রাইব্যুনাল প্রেসিডেন্ট মাইকেল ই স্কেনইডার, প্রফেসর ক্যাম্পবেল ম্যাক লেকলান কিউসি এবং প্রফেসর জন পলসন।এর মধ্যে মাইকেল ই স্কেনইডারকে নিয়োগ দেন মামলার দুইপক্ষ। ম্যাক লেকলানকে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ সরকার আর প্রফেসর জন পলসন ছিলেন কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকো’র পক্ষে।
তিনি বলেন, ‘মামলায় অভিযোগে বলা হয়েছিল, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত দেখিয়ে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর হাতে ‘তুলে দেওয়ার’ মাধ্যমে খালেদা জিয়াসহ আসামিরা রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি করেছেন। কানাডার রয়্যাল মাউন্টেড পুলিশের (আরসিএমপি) ইন্টারন্যাশনাল এন্টিকরাপশন ইউনিট নাইকো দুর্নীতি মামলা নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান চালায়। দুর্নীতির বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে বাংলাদেশ থেকেও। এই তদন্ত পরিচালনায় কানাডা সরকারের ৯ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতি মামলায় এফবিআই ও কানাডা পুলিশ আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে। পরে আদালত নাইকো চুক্তি পর্যালোচনা করে। আদেশে ‘আইসিএসআইডি’ বলেছে, নাইকো চুক্তিতে অনুমোদন লাভে নাইকো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ঘুষ দিয়েছে বলে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে সেসবের পক্ষে কোন প্রমাণ নেই। আইসিএসআইডি তাদের রায়ে ২০১৭ সালে নাইকোর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের হাইকোর্টের একটি আদেশেরও কড়া সমালোচনা করে বলেছে যে, হাইকোর্টের আদেশটি ‘অনিষ্পন্ন বা বিতর্কিত প্রমাণ’ এবং ‘সুস্পষ্টভাবে ত্রুটিযুক্ত তথ্যগত দাবির’ ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও হাইকোর্টের আদেশটিতে কোন প্রমাণ ছাড়াই বিভিন্ন অযাচিত বক্তব্য সন্নিবেশিত হয়েছে বলে সালিশি ট্রাইব্যুনাল মন্তব্য করেছে।
রিজভী বলেন, ‘নাইকো চুক্তি নিয়ে দুটি মামলা হয়েছিল। একটিতে শেখ হাসিনাকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। অপর মামলায় খালেদা জিয়াকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে নিজের নামে থাকা নাইকো মামলা প্রত্যাহার করে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বিচারের নামে কোর্ট বসিয়ে প্রহসন করছে। আমাদের প্রশ্ন হলো, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অফ ইনভেষ্টমেন্ট ডিসপিউটস (আইসিএসআইডি)’র আওতাধীন প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সালিশি ট্রাইব্যুনাল নাইকো চুক্তি নিয়ে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে যে রায় দিয়েছে সেখানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্বও ছিল। তাহলে কেন সেই ট্রাইব্যুনালের রায় এতদিন প্রকাশ করা হয়নি ? অথচ, আমরা এখন দেখছি, সুইডেনভিত্তিক নিউজ মিডিয়া ‘নেট্রা নিউজ’ আদালতের রায়ের এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর এখন বাংলাদেশে ‘নেট্রা নিউজ’ সাইটটি বন্ধ বা ব্লক করে দিয়েছে সরকার। বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো কতটুক চাপে আছে এটি তার প্রমাণ ’
তিন বলেন, ‘আল জাজিরার মাধ্যমে দেশের জনগণকে জানতে হচ্ছে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের খবর। আজ যদি বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে এই রায় যেতো তাহলে বাংলাদেশের সরকারের আজ্ঞাবহ মিডিয়াগুলোর ঘুম হারাম হয়ে যেতো।’
রিজভী বলেন, ‘নাইকো দুর্নীতি মামলায় নিরপেক্ষ বিচারের রায় প্রমাণ করে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা প্রতিটি মামলাই ভুয়া ও নির্জলা মিথ্যা। ওয়ান ইলেভেনের অবৈধ সরকার তাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে দেশবাসীর সামনে তার নিষ্কলুষ ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য মিথ্যা মামলা দেয়। অপরদিকে বর্তমান অবৈধ সরকার একের পর এক মামলা দিচ্ছে বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরাতে ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার বশবর্তী হয়ে। আমরা দেশের মানুষকে শতভাগ নিশ্চিত করে বলতে পারি, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাষ্ট দুর্নীতি মামলা, গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা, বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি মামলা, নাইকো দুর্নীতি মামলা, অবৈধ সম্পদ সংক্রান্ত মামলা, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা, মানহানির মামলা, বিস্ফোরক, হত্যা, নাশকতার মামলাসহ তার নামে যে অর্ধশত মামলা করা হয়েছে সবই মিথ্যা।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘তারেক রহমানের নামে যত মামলা করা হয়েছে সবই মনগড়া, বানোয়াট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।মিথ্যা মামলা দেওয়ার কারণ সকলেই জানেন, বেগম খালেদা জিয়া জনগণের মাঝে সক্রিয় থাকলে অপকর্ম করা যাবে না। লুটপাট করা যাবেনা। দেশকে বিদেশীদের কাছে বিক্রি করা যাবে না। ভোট ডাকাতি করা যাবে না। এ কারণে একটার পর একটা মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। আর এই মিথ্যা মামলা নিয়ে তারা গভীর চক্রান্ত ও প্রহসন করছে। দুটি মিথ্যা মামলার রায়ে সম্পূর্ণ বিনা অপরাধে তাকে সাজা দিয়ে কারাগারে বন্দি রেখে হত্যাচেষ্টা চলছে।’